কাজ কী?

কোনো বস্তুর ওপর যদি কোনো বল প্রয়োগ করা হয় এবং সেই বস্তু বলের দিকেই কিছুটা স্থান পরিবর্তন করে, তাহলে আমরা বলি কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

কাজ সম্পন্ন হওয়ার শর্ত:

১. বস্তুটির ওপর একটি বল প্রয়োগ করতে হবে।
২. বস্তুটি বলের কারণে সরতে হবে।
৩. বলের দিকে সরলরেখায় স্থান পরিবর্তন হতে হবে।

কাজের সূত্র

কাজ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়:

W = F × s × cos⁡θ

এখানে,

  • W = কাজ
  • F = বল
  • s = সরণ
  • θ = বল ও সরণের মধ্যে কোণ

কাজের একক

এসআই পদ্ধতিতে কাজের একক জুল (Joule)

কাজের ধরন

১. ধনাত্মক কাজ: বস্তু বলের দিকেই সরলে কাজ ধনাত্মক হয়।
২. ঋণাত্মক কাজ: যদি বস্তু বলের বিপরীত দিকে সরে, তবে কাজ ঋণাত্মক হয়।
৩. শূন্য কাজ: যদি বস্তু বলের প্রয়োগেও না সরে বা বল ও সরণ পরস্পর লম্বভাবে থাকে, তাহলে কাজ শূন্য হয়।

শক্তি কী?

কোনো বস্তু কাজ করার ক্ষমতা রাখলে, তাকে শক্তি বলে। শক্তি ছাড়া কোনো বস্তু কাজ করতে পারে না।

শক্তির একক

শক্তির একক জুল (Joule), যা এক নিউটন বল দ্বারা এক মিটার দূরত্বে সরানোর সমান।

শক্তির ধরন

শক্তি বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান। এর প্রধান কয়েকটি ধরন হলো—

১. গতিশক্তি (Kinetic Energy)

কোনো বস্তু যখন গতিশীল থাকে, তখন সেটির শক্তিকে গতিশক্তি বলে।

এখানে,

Ek=1/2 mv2

  • m = বস্তুর ভর
  • v = বস্তুর বেগ

উদাহরণ:

  • চলন্ত গাড়ি
  • প্রবাহিত নদী
  • বাতাসে উড়ন্ত পাখি

২. স্থিতিশক্তি (Potential Energy)

কোনো বস্তু উচ্চতায় থাকলে বা স্থিতিস্থাপকতা থাকলে সেটির মধ্যে যে শক্তি সঞ্চিত থাকে, তাকে স্থিতিশক্তি বলে।

Ep=mgh

এখানে,

  • m = বস্তুর ভর
  • g = মহাকর্ষজ ত্বরণ
  • h = উচ্চতা

উদাহরণ:

  • বাঁকানো ধনুক
  • পাহাড়ের চূড়ায় থাকা পাথর
  • প্রসারিত রাবার ব্যান্ড

৩. তাপ শক্তি (Thermal Energy)

বস্তুর অভ্যন্তরীণ অণুগুলোর গতি থেকে উৎপন্ন শক্তিকে তাপ শক্তি বলে।

উদাহরণ:

  • আগুনের তাপ
  • গরম পানির শক্তি

৪. রাসায়নিক শক্তি (Chemical Energy)

কোনো পদার্থের রাসায়নিক বন্ধনের মধ্যে সংরক্ষিত শক্তিকে রাসায়নিক শক্তি বলা হয়।

উদাহরণ:

  • ব্যাটারির শক্তি
  • খাবারের শক্তি
  • পেট্রোল বা ডিজেলের শক্তি

৫. বিদ্যুৎ শক্তি (Electrical Energy)

ইলেকট্রনের প্রবাহ থেকে উৎপন্ন শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তি বলে।

উদাহরণ:

  • বৈদ্যুতিক বাতি
  • ফ্রিজ ও টেলিভিশন
  • মোবাইল চার্জ

৬. আলোক শক্তি (Light Energy)

আলোর মাধ্যমে বহন করা শক্তিকে আলোক শক্তি বলে।

উদাহরণ:

  • সূর্যের আলো
  • বৈদ্যুতিক বাতি
  • লেজার রশ্মি

৭. শব্দ শক্তি (Sound Energy)

বস্তুর কম্পনের ফলে উৎপন্ন শক্তিকে শব্দ শক্তি বলে।

উদাহরণ:

  • সংগীত
  • গাড়ির হর্ন
  • বজ্রপাত

৮. পারমাণবিক শক্তি (Nuclear Energy)

পরমাণুর কেন্দ্রের বিভাজন বা সংযোজনের ফলে উৎপন্ন শক্তিকে পারমাণবিক শক্তি বলে।

উদাহরণ:

  • পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
  • সূর্যের শক্তি উৎপাদন

শক্তির বিভিন্ন উৎস:

 শক্তির উৎস মূলত দুই ধরনের—নবায়নযোগ্য (Renewable) ও অ নবায়নযোগ্য (Non-renewable)। 

১. নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস

নবায়নযোগ্য শক্তি এমন একটি উৎস, যা প্রাকৃতিকভাবে পুনরায় তৈরি হয় এবং কখনো শেষ হয়ে যায় না।

১.সৌর শক্তি: 

সৌর শক্তি কী?

সৌর শক্তি হলো সূর্যের তাপ ও আলোকে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া। এটি দুইভাবে সংগ্রহ করা যায়—

সৌর শক্তি কী?
  1. সৌর বিদ্যুৎ (Solar Power): সৌর প্যানেলের মাধ্যমে সূর্যের আলোকে বিদ্যুতে রূপান্তর করা হয়।
  2. সৌর তাপশক্তি (Solar Thermal Energy): সূর্যের তাপ ব্যবহার করে পানি গরম করা বা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

সৌর শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া

(ক) ফটোভোল্টাইক কোষ (Photovoltaic Cells)

ফটোভোল্টাইক কোষ (Photovoltaic Cells)
  • সৌর প্যানেলের সিলিকন কোষ সূর্যের আলো শোষণ করে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করে।
  • এটি সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যা ব্যাটারিতে সংরক্ষণ করা যায়।

(খ) সৌর তাপবিদ্যুৎ (Solar Thermal Power)

  • সূর্যের তাপ সংগ্রহ করে বাষ্প তৈরি করা হয়, যা টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে।
  • বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।

সৌর শক্তির ব্যবহার

  • বিদ্যুৎ উৎপাদন: সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বাড়ি, অফিস ও কল-কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ।
  • পানি গরম করা: সৌর গিজার ব্যবহার করে পানি গরম করা।
  • রান্না: সৌরচালিত কুকার ব্যবহার করে রান্নার কাজ সম্পন্ন করা।
  • সেচ ব্যবস্থা: সৌরচালিত পানির পাম্প ব্যবহার করে কৃষি জমিতে পানি সরবরাহ।
  • গৃহস্থালি কাজ: সৌর বিদ্যুৎচালিত ফ্যান, বাতি, ফ্রিজ ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালানো।
  • পরিবহন ব্যবস্থা: সৌর শক্তিচালিত গাড়ি, ট্রেন ও নৌযান পরিচালনা।
  • মহাকাশ গবেষণা: উপগ্রহ, মহাকাশ স্টেশন ও মহাকাশযানে শক্তি সরবরাহ।
  • রাস্তার আলো: সৌরবিদ্যুৎচালিত স্ট্রিট লাইট ব্যবহার।
  • দূরবর্তী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ: যেখানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছেনি, সেখানে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার।
  • শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যবহার: সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বড় আকারে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ।

সৌর শক্তির সুবিধা

  • নবায়নযোগ্য শক্তি: এটি কখনো শেষ হবে না, কারণ সূর্য অনবরত শক্তি প্রদান করে।
  • পরিবেশবান্ধব: সৌর শক্তি ব্যবহার করলে বায়ু দূষণ ও কার্বন নিঃসরণ হয় না।
  • অর্থনৈতিক সাশ্রয়ী: একবার সৌর প্যানেল স্থাপন করলে দীর্ঘ সময় বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
  • কম রক্ষণাবেক্ষণ: সৌর প্যানেল স্থাপনের পর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন খুব কম।
  • বৈদ্যুতিক বিল কমায়: সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে বিদ্যুতের ব্যয় অনেক কমে যায়।
  • গ্রামাঞ্চলে কার্যকর: যেখানে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড নেই, সেখানে সহজে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়।
  • নানা কাজে ব্যবহারযোগ্য: বিদ্যুৎ উৎপাদন, রান্না, পানি গরম, সেচ ব্যবস্থা, পরিবহন ইত্যাদিতে ব্যবহার করা যায়।
  • শব্দদূষণ মুক্ত: সৌর শক্তি উৎপাদন ও ব্যবহার করতে কোনো শব্দ হয় না।
  • দীর্ঘস্থায়ী: ভালো মানের সৌর প্যানেল ২০-২৫ বছর পর্যন্ত কার্যকরভাবে কাজ করে।
  • বিশ্বব্যাপী সহজলভ্য: সূর্যের আলো পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যায়, তাই এটি সর্বত্র ব্যবহার করা সম্ভব।

সৌর শক্তির চ্যালেঞ্জ

  • উচ্চ প্রাথমিক খরচ: সৌর প্যানেল ও সিস্টেম স্থাপনের জন্য শুরুতে অনেক খরচ হয়।
  • আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীলতা: মেঘলা বা বৃষ্টির দিনে সৌর শক্তি উৎপাদন কমে যায়।
  • বিশাল জায়গার প্রয়োজন: বৃহৎ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য অনেক জায়গা প্রয়োজন।
  • শক্তি সংরক্ষণ: সৌর শক্তি রাতের বেলায় বা মেঘলা দিনে ব্যবহারের জন্য ভালো মানের ব্যাটারি প্রয়োজন, যা ব্যয়বহুল।
  • নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজন: সৌর শক্তি আরো দক্ষভাবে ব্যবহার করার জন্য নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন জরুরি।
  • দীর্ঘ মেয়াদী পারফরম্যান্স: সৌর প্যানেলের কর্মক্ষমতা সময়ের সাথে কমে যেতে পারে, যদিও অনেক সময় স্থায়ী।
  • নির্ভরযোগ্যতা: সৌর শক্তি পুরোপুরি নির্ভর করে সূর্যের উপস্থিতির ওপর, তাই এর নির্ভরযোগ্যতা কিছুটা কম।
  • গ্রামীণ এলাকায় অবকাঠামো সীমাবদ্ধতা: গ্রামীণ বা দূরবর্তী এলাকায় সৌর শক্তির ব্যবহার সীমিত হতে পারে অবকাঠামোর অভাবে।

২.বায়ু শক্তি: 

বায়ু শক্তি কী?

বায়ু শক্তি হল বাতাসের গতির মাধ্যমে যে শক্তি উৎপন্ন হয়। বাতাসের গতিশক্তি কখনোই শেষ হয় না, তাই এটি একটি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। বায়ু টারবাইন বাতাসের গতিকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়।
বায়ু শক্তি কী?

বায়ু শক্তির উৎপাদনের প্রক্রিয়া

বায়ু শক্তি উৎপাদন করার জন্য সাধারণত বায়ু টারবাইন ব্যবহার করা হয়। বায়ু টারবাইনে তিনটি ব্লেড থাকে যা বাতাসের গতিতে ঘোরে। এই ঘূর্ণন শক্তি টারবাইনের শ্যাফটের মাধ্যমে জেনারেটরে পৌঁছায়, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

বায়ু শক্তির উপাদান:

  1. বায়ু টারবাইন ব্লেড: বাতাসের গতিশক্তি গ্রহণ করে ঘুরে।
  2. জেনারেটর: ঘূর্ণনের শক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে।
  3. টাওয়ার: টারবাইনকে উচ্চতায় স্থাপন করে, যাতে বাতাসের গতি বাড়ে।
  4. নেটওয়ার্ক সংযোগ: উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিডে প্রবাহিত হয়।

বায়ু শক্তির সুবিধা

  • নবায়নযোগ্য শক্তি: এটি কখনো শেষ হবে না, কারণ বাতাস অবিরত প্রবাহিত থাকে।
  • পরিবেশবান্ধব: বায়ু শক্তি উৎপাদনে কোনো ধরনের দূষণ বা কার্বন নিঃসরণ হয় না।
  • অর্থনৈতিক সাশ্রয়ী: একবার স্থাপন করলে বায়ু টারবাইন দীর্ঘকাল কার্যকর থাকে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমিয়ে দেয়।
  • শক্তির উৎসের বৈচিত্র্য: পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বায়ু শক্তি ব্যবহার করা যায়, যেখানে বাতাসের গতি উপযুক্ত।
  • স্থায়ী সমাধান: এটি একটি টেকসই শক্তির উৎস, যা পৃথিবীকে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।

বায়ু শক্তির ব্যবহার

  • বিদ্যুৎ উৎপাদন: বায়ু টারবাইন ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়।
  • পানি পাম্পিং: কৃষিতে পানি উত্তোলন ও সেচের কাজে বায়ু শক্তি ব্যবহার করা হয়।
  • দূরবর্তী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ: গ্রামাঞ্চলে বা বিদ্যুৎ গ্রিডের বাইরে বায়ু শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব।
  • পরিবহন: পরীক্ষামূলকভাবে বায়ু শক্তি দিয়ে জাহাজ ও অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থা চালানোর চেষ্টা চলছে।

বায়ু শক্তির চ্যালেঞ্জ

  • আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীলতা: বায়ু শক্তি বাতাসের গতির ওপর নির্ভরশীল, তাই বাতাস না থাকলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়।
  • বিশাল জায়গার প্রয়োজন: বায়ু টারবাইনের জন্য অনেক জায়গা প্রয়োজন, যা প্রাকৃতিক পরিবেশে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
  • শব্দ দূষণ: বায়ু টারবাইনের ঘূর্ণন কিছুটা শব্দ সৃষ্টি করতে পারে, যা আশেপাশের এলাকার জন্য বিরক্তিকর হতে পারে।
  • প্রাণীজগতের প্রভাব: বায়ু টারবাইন পাখিদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ তারা ব্লেডে আঘাত পেতে পারে।

৩. জলবিদ্যুৎ (Hydropower)

জলবিদ্যুৎ শক্তি: পরিচ্ছন্ন শক্তির একটি উৎস

জলবিদ্যুৎ শক্তি বা হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার হল জলপ্রবাহের গতিশক্তি থেকে উৎপন্ন শক্তি। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে প্রচলিত নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে পরিচিত। জলবিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা জলাধার বা নদী থেকে প্রবাহিত পানির শক্তি ব্যবহার করে টারবাইন চালিয়ে বিদ্যুৎ জেনারেটরে রূপান্তরিত হয়। জলবিদ্যুৎ শক্তি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই শক্তির উৎস, যা বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

জলবিদ্যুৎ (Hydropower)

জলবিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন প্রক্রিয়া

জলবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে সাধারণত দুটি উপায় ব্যবহার করা হয়:

  1. ধারা শক্তি: নদী বা জলধারা থেকে সরাসরি পানির গতি ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন।
  2. রিজার্ভয়ার শক্তি: একটি জলাধারে পানি সংরক্ষণ করে, সেই পানি মুক্ত করে টারবাইন চালানো হয়।

প্রক্রিয়া:

  • পানির প্রবাহ টারবাইনকে ঘোরায়, যা একটি জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
  • উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযোগিত হয় এবং প্রয়োজন অনুসারে বিতরণ করা হয়।

জলবিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার

  • বিদ্যুৎ উৎপাদন: প্রধানত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
  • পানি সঞ্চয় ও সেচ ব্যবস্থা: জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা কৃষিকাজে সেচের জন্য সহায়তা করে।
  • বিশাল পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহ: বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো শহর ও শিল্পাঞ্চলে ব্যাপক পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
  • বন্যা নিয়ন্ত্রণ: জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজও করে, কারণ তারা প্রবাহিত পানি নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।

জলবিদ্যুৎ শক্তির সুবিধা

  • নবায়নযোগ্য: জলবিদ্যুৎ শক্তি একটি নবায়নযোগ্য শক্তি, যা কখনো শেষ হবে না।
  • পরিবেশবান্ধব: জলবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে কোনো ধরনের বায়ু দূষণ বা কার্বন নিঃসরণ হয় না।
  • শক্তির স্থিতিশীল উৎস: জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো খুবই স্থিতিশীল, এবং দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম।
  • দ্রুত উৎপাদন ক্ষমতা: জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে সক্ষম।
  • দীর্ঘ মেয়াদী সুবিধা: একবার স্থাপন করলে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দীর্ঘ সময়ের জন্য কার্যকর থাকে।
  • অর্থনৈতিক লাভ: জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি দীর্ঘ মেয়াদে সাশ্রয়ী ও লাভজনক।

জলবিদ্যুৎ শক্তির চ্যালেঞ্জ

  • প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর প্রভাব: জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশ, যেমন নদী, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
  • বড় পরিমাণ জমির প্রয়োজন: জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে অনেক বড় জায়গা প্রয়োজন, যা কখনো কখনো স্থানীয় জনগণের ক্ষতি করতে পারে।
  • বন্যার ঝুঁকি: কিছু ক্ষেত্রে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ থেকে বিপুল পরিমাণ পানি ছাড়লে, এটি আশপাশের এলাকায় বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।
  • উচ্চ প্রাথমিক খরচ: জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য উচ্চ প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা অনেক সময় সাশ্রয়ী হতে পারে না।
  • নদীর প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ: জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, যা সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

৪.জিওথার্মাল শক্তি (Geothermal Energy)

জিওথার্মাল শক্তি: প্রকৃতির গভীর থেকে এক অবিশ্বাস্য শক্তি

জিওথার্মাল শক্তি হলো ভূ-তাপীয় শক্তি, যা পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ থেকে উৎপন্ন হয়। এটি নবায়নযোগ্য শক্তির একটি উৎস, যা পৃথিবীর গভীরে থাকা উত্তপ্ত ম্যাগমা, গরম জলাশয় ও বাষ্প থেকে আসে।

জিওথার্মাল শক্তি (Geothermal Energy)

জিওথার্মাল শক্তির উৎপত্তি

পৃথিবীর কেন্দ্রভাগ অত্যন্ত উত্তপ্ত—প্রায় ৫,০০০°C বা তার বেশি। এই তাপ মূলত রেডিওএকটিভ উপাদানের ক্ষয়, প্রাকৃতিক ভূ-গঠনের প্রক্রিয়া এবং মহাকাশ থেকে আসা শক্তির কারণে সৃষ্টি হয়। ভূপৃষ্ঠের নিচে থাকা গরম পাথর ও জল এই তাপ শোষণ করে এবং ভূ-গর্ভস্থ জলাশয় গরম হয়ে যায়। এই গরম জল ও বাষ্প বিভিন্ন উৎসের মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠে আসে, যা জিওথার্মাল শক্তির মূল ভিত্তি।

জিওথার্মাল শক্তি কীভাবে কাজ করে?

জিওথার্মাল শক্তি ব্যবহারের প্রধান উপায় তিনটি—

  1. ডাইরেক্ট ইউজ (সরাসরি ব্যবহার): গরম পানির উৎস যেমন হট স্প্রিং বা গিজার থেকে তাপ নিয়ে ঘর গরম করা, গ্রীনহাউস গরম রাখা এবং শিল্পে ব্যবহার করা হয়।
  2. জিওথার্মাল হিট পাম্প (Geothermal Heat Pump): শীতকালে ঘর গরম ও গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা রাখার জন্য মাটির নিচের উষ্ণতা ব্যবহার করা হয়।
  3. জিওথার্মাল পাওয়ার প্লান্ট: বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভূ-গর্ভস্থ গরম জল ও বাষ্প ব্যবহার করা হয়। এটি তিনভাবে করা যায়—
    • ড্রাই স্টিম প্লান্ট: সরাসরি বাষ্প ব্যবহার করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়।
    • ফ্ল্যাশ স্টিম প্লান্ট: উচ্চ চাপের গরম জলকে হঠাৎ কম চাপের পরিবেশে এনে বাষ্পে রূপান্তর করে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়।
    • বাইনারি সাইকেল প্লান্ট: ভূ-গর্ভস্থ গরম জল থেকে তাপ নিয়ে অন্য তরলকে বাষ্পে পরিণত করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

জিওথার্মাল শক্তির সুবিধা

  • নবায়নযোগ্য ও টেকসই: এই শক্তি অবিরাম পাওয়া যায় এবং ফসিল ফুয়েলের মতো শেষ হয়ে যায় না।
  • পরিবেশবান্ধব: এটি তুলনামূলকভাবে কম কার্বন নির্গমন করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সহায়ক।
  • কম খরচে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার: একবার স্থাপনের পর এটি কম রক্ষণাবেক্ষণে দীর্ঘ সময় চলে।
  • স্থিতিশীল ও নিরবচ্ছিন্ন: বায়ু ও সৌরশক্তির মতো আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে না।

জিওথার্মাল শক্তির চ্যালেঞ্জ

  • প্রাথমিক খরচ বেশি: গভীর খনন ও অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয়বহুল।
  • নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ: শুধুমাত্র ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় এলাকায় বেশি কার্যকর।
  • ভূমিকম্পের ঝুঁকি: গভীর খননের ফলে ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে।

বিশ্বে ও বাংলাদেশে জিওথার্মাল শক্তির ব্যবহার

বিশ্বের অনেক দেশ, যেমন আইসল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, ও ইতালি, জিওথার্মাল শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বাংলাদেশে এখনো এ খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি, তবে উত্তরের কিছু এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ গরম পানির উৎস পাওয়া গেছে, যা ভবিষ্যতে সম্ভাবনাময় হতে পারে।

৫. সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা শক্তি (Tidal & Wave Energy)

সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা হলো প্রকৃতির এক অবিশ্বাস্য ঘটনা, যা চাঁদের মহাকর্ষীয় টানের কারণে ঘটে। এই জোয়ার-ভাটার গতিবিধি থেকে শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব, যাকে বলা হয় জোয়ার-ভাটার শক্তি (Tidal Energy)। এটি নবায়নযোগ্য শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস, যা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম।

সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা শক্তি (Tidal & Wave Energy)

জোয়ার-ভাটার শক্তি কীভাবে কাজ করে?

জোয়ার-ভাটার শক্তি উৎপাদনের প্রধান উপায় হলো সমুদ্রের পানির উচ্চতা পরিবর্তনকে কাজে লাগানো। যখন জোয়ার আসে, তখন বিশাল পরিমাণ পানি উপকূলে উঠে আসে, এবং যখন ভাটা হয়, তখন তা ফিরে যায়। এই ওঠা-নামার শক্তিকে ব্যবহার করে টারবাইন ঘোরানো হয়, যা বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে।

জোয়ার-ভাটার শক্তি উৎপাদনের প্রধান পদ্ধতি

১. টাইডাল ব্যারেজ (Tidal Barrage)

  • এটি বাঁধের মতো একটি কাঠামো, যা নদীর মোহনা বা উপসাগরের প্রবেশপথে নির্মাণ করা হয়।
  • জোয়ারের সময় পানি বাঁধের পেছনে জমা হয় এবং যখন ভাটা শুরু হয়, তখন এই পানি ছেড়ে দেওয়া হয়, যা টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
  • উদাহরণ: ফ্রান্সের La Rance Tidal Power Station, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টাইডাল প্লান্ট।
  1. টাইডাল স্ট্রিম টারবাইন (Tidal Stream Turbine)
    • পানির প্রবাহের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পানির নিচে থাকা বিশাল টারবাইন ঘোরানো হয়।
    • এটি বাতাসের টারবাইনের মতো কাজ করে, তবে পানির ঘনত্ব বেশি হওয়ায় এটি অধিক শক্তি উৎপাদনে সক্ষম।
    • এটি পরিবেশবান্ধব, কারণ এটি কোনো বাঁধ তৈরি না করেও কাজ করতে পারে।
  2. ডাইনামিক টাইডাল পাওয়ার (DTP)
    • এটি একটি নতুন প্রযুক্তি, যেখানে দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করা হয় এবং এতে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
    • এটি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।

জোয়ার-ভাটার শক্তির সুবিধা

  • নবায়নযোগ্য এবং অবিরাম: চাঁদের টানে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা চিরকাল থাকবে, তাই এই শক্তির সরবরাহ শেষ হওয়ার আশঙ্কা নেই।
  • পরিবেশবান্ধব: এতে কার্বন নির্গমন নেই এবং এটি জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না।
  • নির্ভরযোগ্য শক্তি: বায়ু ও সৌরশক্তির মতো আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে না, কারণ জোয়ার-ভাটার সময়সূচি পূর্বাভাসযোগ্য।
  • দীর্ঘস্থায়ী অবকাঠামো: একবার নির্মাণের পর এটি বহু বছর ধরে কাজ করতে পারে।

জোয়ার-ভাটার শক্তির চ্যালেঞ্জ

  • উচ্চ নির্মাণ খরচ: টারবাইন বা বাঁধ নির্মাণ ব্যয়বহুল, যা অনেক দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
  • পরিবেশগত প্রভাব: টাইডাল ব্যারেজ নির্মাণের ফলে সামুদ্রিক জীবজন্তুর গতিবিধি ও বাস্তুসংস্থান পরিবর্তিত হতে পারে।
  • নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ: এই শক্তি উৎপাদনের জন্য উপকূলীয় এলাকার প্রয়োজন, যা সব দেশে সহজলভ্য নয়।
  • রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন: সামুদ্রিক পরিবেশের কারণে যন্ত্রপাতি নোনাজলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন করে।

বিশ্বে জোয়ার-ভাটার শক্তির ব্যবহার

বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে জোয়ার-ভাটার শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্র হলো—

  • La Rance Tidal Power Station (ফ্রান্স) – ২৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্লান্ট।
  • Sihwa Lake Tidal Power Station (দক্ষিণ কোরিয়া) – এটি বিশ্বের বৃহত্তম জোয়ার-ভাটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যার উৎপাদন ক্ষমতা ২৫৪ মেগাওয়াট।
  • MeyGen Project (স্কটল্যান্ড) – এটি টাইডাল স্ট্রিম টারবাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

বাংলাদেশে জোয়ার-ভাটার শক্তির সম্ভাবনা

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা, বিশেষ করে সুন্দরবন, কক্সবাজার ও পটুয়াখালী অঞ্চলে জোয়ার-ভাটার শক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই এলাকায় পর্যাপ্ত জোয়ার-ভাটা বিদ্যমান, যা টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়ক হতে পারে।

২. অনবায়নযোগ্য শক্তির উৎস

এই শক্তি প্রাকৃতিকভাবে সীমিত এবং একবার ব্যবহারের পর পুনরায় তৈরি হতে বহু বছর সময় লাগে।

১. জীবাশ্ম জ্বালানি (Fossil Fuels)

জীবাশ্ম জ্বালানি (Fossil Fuels) হলো এমন এক শক্তির উৎস, যা লক্ষ কোটি বছর ধরে ভূগর্ভে জমে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবাশ্ম থেকে তৈরি হয়েছে। এটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শিল্প, পরিবহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গৃহস্থালী কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শক্তি। তবে এটি যেমন অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম চালিকাশক্তি, তেমনি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিও বটে।

জীবাশ্ম জ্বালানি (Fossil Fuels)

এই শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রধানত তিন ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়:

  1. কয়লা (Coal) – শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস, যা শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
  2. পেট্রোলিয়াম বা অপরিশোধিত তেল (Crude Oil) – গাড়ি, বিমান ও বিভিন্ন যন্ত্রচালিত প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়।
  3. প্রাকৃতিক গ্যাস (Natural Gas) – রান্না, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হয়।

জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপত্তি

লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে থাকা উদ্ভিদ ও সামুদ্রিক প্রাণীগুলো ভূগর্ভের গভীরে জমা হয়ে সময়ের সাথে সাথে তীব্র চাপ ও তাপের কারণে রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে কয়লা, তেল ও গ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি লক্ষ কোটি বছর ধরে চলে আসছে, তাই জীবাশ্ম জ্বালানিকে Non-Renewable Energy বলা হয়। একবার ব্যবহৃত হলে এটি পুনরায় তৈরি হতে কোটি কোটি বছর সময় লাগে।

জীবাশ্ম জ্বালানির সুবিধা

১. উচ্চ শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা

  • জীবাশ্ম জ্বালানি অত্যন্ত শক্তিশালী জ্বালানির উৎস।
  • এটি স্বল্প পরিমাণে ব্যবহার করেও প্রচুর শক্তি উৎপাদন করা যায়।
  • উদাহরণ: ১ কেজি কয়লা পোড়ালে প্রায় ২৪ মেগাজুল (MJ) শক্তি উৎপন্ন হয়।

২. সহজলভ্যতা ও অবকাঠামো উন্নত

  • বিশ্বব্যাপী প্রচুর পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানি পাওয়া যায়।
  • তেল, গ্যাস ও কয়লা উত্তোলনের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও অবকাঠামো বিদ্যমান।
  • বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্র ও যানবাহন সহজেই এই জ্বালানি ব্যবহার করতে পারে।

৩. নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য শক্তি সরবরাহ

  • জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে ২৪/৭ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
  • এটি সৌর ও বায়ুশক্তির মতো আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়।

৪. তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল (সাশ্রয়ী)

  • নবায়নযোগ্য জ্বালানির তুলনায় জীবাশ্ম জ্বালানি এখনো সস্তা।
  • কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম তুলনামূলকভাবে কম।

৫. শিল্প ও অর্থনীতির ভিত্তি

  • বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, এবং কলকারখানার জন্য প্রধান জ্বালানি উৎস।
  • অনেক দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবসার ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল।

৬. পরিবহনে বহুল ব্যবহৃত

  • পেট্রোল, ডিজেল ও গ্যাসবাহী যানবাহন সহজলভ্য এবং বিশ্বব্যাপী বহুল ব্যবহৃত।
  • আধুনিক ইঞ্জিন ও যানবাহন এই জ্বালানির জন্য উপযোগী।

৭. তাত্ক্ষণিক জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার

  • এটি দ্রুত জ্বলে এবং তাৎক্ষণিকভাবে শক্তি উৎপন্ন করতে পারে।
  • বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কম সময় লাগে।

৮. মজুদকরণ ও সংরক্ষণ সহজ

  • প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল ও কয়লা সহজেই সংরক্ষণ করা যায়।
  • ব্যাটারি বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো জটিল সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না।

৯. বিভিন্ন খাতে বহুমুখী ব্যবহার

  • বিদ্যুৎ উৎপাদন (কয়লা ও গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্র)
  • পরিবহন (গাড়ি, ট্রাক, বিমান, জাহাজ)
  • শিল্প খাত (ইস্পাত, সিমেন্ট, রাসায়নিক কারখানা)
  • গৃহস্থালি ব্যবহার (রান্নার গ্যাস, তাপ উৎপাদন)

জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর দিক

১. বায়ুদূষণ

  • কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) নির্গমন:
    • রাসায়নিক বিক্রিয়া: C + O₂ → CO₂
    • গ্রিনহাউস গ্যাস, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায়।
  • কার্বন মনোক্সাইড (CO) উৎপাদন:
    • অসম্পূর্ণ দহনের ফলে তৈরি হয়।
    • রাসায়নিক বিক্রিয়া: 2C+O2→2CO
    • বিষাক্ত গ্যাস, যা রক্তে অক্সিজেন পরিবহন ব্যাহত করে।
  • সালফার ডাই-অক্সাইড (SO₂) উৎপাদন:
    • কয়লা ও পেট্রোলিয়ামে থাকা সালফার পোড়ালে তৈরি হয়।
    • রাসায়নিক বিক্রিয়া: S+O2→SO2
    • অ্যাসিড বৃষ্টির কারণ হয়।
  • নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) উৎপাদন:
    • উচ্চ তাপমাত্রায় দহনের ফলে তৈরি হয়।
    • রাসায়নিক বিক্রিয়া: N2+O2→2NO 
  • ওজোন স্তরের ক্ষতি করে এবং অ্যাসিড বৃষ্টি ঘটায়।

২. গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও জলবায়ু পরিবর্তন

  • জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস (CO₂, CH₄, NOx) নির্গত হয়।
  • ফলাফল:
    • পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
    • মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায়।
    • চরম আবহাওয়া (খরা, ঝড়, বন্যা) বৃদ্ধি পায়।

৩. অ্যাসিড বৃষ্টি

  • জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে SO₂ ও NO₂ ছড়িয়ে পড়ে এবং পানির সাথে বিক্রিয়া করে অ্যাসিড তৈরি করে।
  • রাসায়নিক বিক্রিয়া: SO₂ + H₂O → H₂SO₃

2NO₂ + H₂O → HNO₂ + HNO₃

  • ফলাফল:
    • মাটির উর্বরতা কমে যায়।
    • জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয়।
    • ভবন ও স্থাপনার ক্ষতি হয়।

৪. মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি

  • বায়ুদূষণের কারণে:
    • শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা ও ফুসফুসের রোগ হয়।
    • কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়া রক্তে অক্সিজেন প্রবাহ কমিয়ে দেয়।
    • সালফার ও নাইট্রোজেন অক্সাইড হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

৫. পরিবেশের ক্ষতি ও জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস

  • তেল নিঃসরণ (Oil Spills):
    • সমুদ্রে তেল ছড়িয়ে পড়লে সামুদ্রিক প্রাণী ও বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি হয়।
    • উদাহরণ: Deepwater Horizon (2010), যা মেক্সিকো উপসাগরের পরিবেশ ধ্বংস করেছিল।
  • খনি ও ড্রিলিংয়ের ক্ষতি:
    • কয়লা খনন ও তেল উত্তোলনের ফলে ভূমিধস ও পানিদূষণ ঘটে।

৬. ভূরাজনৈতিক সমস্যা ও যুদ্ধ

  • তেলের জন্য যুদ্ধ:
    • জীবাশ্ম জ্বালানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিভিন্ন দেশে সংঘাত হয়।
    • উদাহরণ: গালফ ওয়ার (১৯৯০-৯১), যেখানে কুয়েতের তেল সম্পদ নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিল।
  • অর্থনৈতিক নির্ভরতা:
    • তেল ও গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো জ্বালানির দামের ওঠানামার কারণে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে।

৭. অপ্রতিস্থাপনযোগ্য সম্পদ (Non-Renewable Resource)

  • জীবাশ্ম জ্বালানি সীমিত পরিমাণে বিদ্যমান
  • বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ৫০-১০০ বছরের মধ্যে পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যেতে পারে।

২. পারমাণবিক শক্তি (Nuclear Energy)

পারমাণবিক শক্তি হল এমন এক শক্তির উৎস, যা নিউক্লিয়ার বিভাজন (Nuclear Fission) বা নিউক্লিয়ার সংযোজন (Nuclear Fusion) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। এটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও কার্যকর জ্বালানি উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পারমাণবিক শক্তি থেকে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, যা শিল্প, গবেষণা, চিকিৎসা এবং মহাকাশ অভিযানে ব্যবহৃত হয়।

পারমাণবিক শক্তির উৎপাদন প্রক্রিয়া

পারমাণবিক শক্তি মূলত দুটি পদ্ধতিতে উৎপন্ন করা হয়—

১. নিউক্লিয়ার বিভাজন (Nuclear Fission)

  • ভারী পরমাণু (যেমন ইউরেনিয়াম-২৩৫ বা প্লুটোনিয়াম-২৩৯) নিউক্লিয়াস ভাগ হয়ে বিশাল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে।
  • এটি বর্তমানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উপায়।
  • রাসায়নিক বিক্রিয়া: 235U+n→92Kr+141Ba+3n
  • উদাহরণ: চেরনোবিল (উক্রেন), ফুকুশিমা (জাপান), কাশিওয়াজাকি-কারিওয়া (জাপান), ব্রুস (কানাডা)

২. নিউক্লিয়ার সংযোজন (Nuclear Fusion)

  • দুটি হালকা পরমাণু (যেমন হাইড্রোজেন আইসোটোপ – ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম) একত্রিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে।
  • এটি সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রের শক্তির প্রধান উৎস।
  • রাসায়নিক বিক্রিয়া: 2H+3H→4He+n
  • এটি পরিবেশবান্ধব ও অধিক শক্তিশালী, তবে এখনো বাণিজ্যিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
  • বর্তমানে ITER (International Thermonuclear Experimental Reactor)-এর মতো প্রকল্পগুলো নিউক্লিয়ার সংযোজনের বাস্তবায়নের জন্য গবেষণা চালাচ্ছে।

পারমাণবিক শক্তির প্রধান উৎস

১. ইউরেনিয়াম (Uranium)

ইউরেনিয়াম (Uranium)
  • প্রধানত ইউরেনিয়াম-২৩৫ নিউক্লিয়ার বিভাজনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
  • এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খনির মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়, যেমন—
    • কাজাখস্তান (বিশ্বের শীর্ষ ইউরেনিয়াম উৎপাদক)
    • অস্ট্রেলিয়া
    • কানাডা
    • রাশিয়া
    • নামিবিয়া

২. প্লুটোনিয়াম (Plutonium-239)

প্লুটোনিয়াম (Plutonium-239)
  • এটি ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম জ্বালানির পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পাওয়া যায়।
  • পারমাণবিক অস্ত্র ও গবেষণা চুল্লিতে ব্যবহৃত হয়।

পারমাণবিক শক্তির সুবিধা

পারমাণবিক শক্তি অনেক দিক থেকে উপকারী। এর কিছু প্রধান সুবিধা নিচে দেওয়া হলো—

১. উচ্চ শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা

  • অল্প পরিমাণ ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম থেকে বিশাল শক্তি পাওয়া যায়।
  • ১ কেজি ইউরেনিয়াম থেকে কয়লার তুলনায় ৩ মিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি পাওয়া যায়।

২. পরিবেশবান্ধব ও কম কার্বন নির্গমন

  • জ্বালানি পোড়ানোর প্রয়োজন হয় না, তাই CO₂ বা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয় না।
  • জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমাতে সাহায্য করে।

৩. নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ

  • ২৪/৭ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, যা সৌর বা বায়ুশক্তির মতো আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়।

৪. তুলনামূলক কম জায়গায় বিদ্যুৎ উৎপাদন

  • একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
  • কয়লা বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের তুলনায় কম জমি লাগে।

৫. অন্যান্য খাতে বহুমুখী ব্যবহার

  • গবেষণা ও চিকিৎসায় (যেমন ক্যান্সার থেরাপি, রেডিওথেরাপি)।
  • নৌবাহিনী ও মহাকাশ অভিযানে পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর ব্যবহৃত হয়।

পারমাণবিক শক্তির ক্ষতিকর দিক

যদিও পারমাণবিক শক্তির অনেক সুবিধা রয়েছে, তবে এটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিও বহন করে—

১. তেজস্ক্রিয় বর্জ্য (Radioactive Waste)

  • পারমাণবিক চুল্লি থেকে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয়।
  • এগুলো নিরাপদে সংরক্ষণ করা কঠিন ও ব্যয়বহুল।

২. পারমাণবিক দুর্ঘটনা (Nuclear Accidents)

  • চেরনোবিল (১৯৮৬) ও ফুকুশিমা (২০১১)-এর মতো দুর্ঘটনা মারাত্মক ক্ষতি করেছে।
  • দূষণ কয়েক দশক বা শতাব্দী ধরে পরিবেশে প্রভাব ফেলতে পারে।

৩. পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি

  • পারমাণবিক শক্তির জ্ঞান ও উপাদান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
  • হিরোশিমা ও নাগাসাকি বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এখনো মনে করিয়ে দেয় এর বিপদ।

৪. নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয়বহুল

  • একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে বিলিয়ন ডলার খরচ হয়।
  • রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যয়বহুল ও জটিল।

বিশ্বে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

  • শীর্ষ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ:
    • যুক্তরাষ্ট্র – ৯০+ পারমাণবিক চুল্লি
    • ফ্রান্স – ৭০% বিদ্যুৎ পারমাণবিক শক্তি থেকে
    • চীন, রাশিয়া, জাপান, ভারত – পারমাণবিক শক্তির দ্রুত বিকাশ

শক্তির নিত্যতা সূত্র (Law of Conservation of Energy)

শক্তির নিত্যতা সূত্র বা শক্তির সংরক্ষণ সূত্র হল এক গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা, যা বলে যে শক্তি কখনোই সৃষ্টি বা ধ্বংস হয় না; বরং এটি এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে রূপান্তরিত হয়।

মূল ধারণা

  • শক্তি নষ্ট বা তৈরি করা যায় না, এটি কেবল রূপান্তরিত হয়।
  • একে কখনো শক্তির সংরক্ষণ সূত্র বলে উল্লেখ করা হয়।
  • উদাহরণ: যতটুকু শক্তি একটি সিস্টেমে প্রবাহিত হয়, তা সমান পরিমাণে অন্য কোথাও চলে যায়।

গণনা

Einitial=Efinal

এখানে,

  • Einitial= হলো শক্তির প্রথম অবস্থান,
  • Efinal=হলো শক্তির পরবর্তী অবস্থান।

শক্তির বিভিন্ন রূপ:

  • তাপ শক্তি
  • কাইনেটিক শক্তি
  • পটেনশিয়াল শক্তি
  • রেডিয়েন্ট শক্তি (আলোক শক্তি)
  • কেমিক্যাল শক্তি

একটি সাধারণ উদাহরণ:
একটি স্লিপিং বোলার (বিন্দু) শুরুতে পটেনশিয়াল শক্তি ধারণ করে, তারপর এটি গতি পায় এবং কাইনেটিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

শক্তির রূপান্তর (Energy Transformation)

শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। শক্তির রূপান্তর প্রক্রিয়া দৈনন্দিন জীবনে নানা যন্ত্র ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে।

রূপান্তরের প্রক্রিয়া:

১. কাইনেটিক শক্তি (Kinetic Energy) থেকে পটেনশিয়াল শক্তি (Potential Energy)

  • উদাহরণ: একটি বাঁধের জলাশয় থেকে জল একত্রিত হয়ে পটেনশিয়াল শক্তি ধারণ করে, যা পরবর্তীতে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে কাইনেটিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

২. কেমিক্যাল শক্তি (Chemical Energy) থেকে তাপ শক্তি (Heat Energy)

  • উদাহরণ: কয়লা বা গ্যাস পোড়ানোর সময় কেমিক্যাল শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।

৩. তাপ শক্তি (Heat Energy) থেকে মেকানিক্যাল শক্তি (Mechanical Energy)

  • উদাহরণ: বাষ্প ইঞ্জিন একটি সাধারণ উদাহরণ, যেখানে তাপ শক্তি মেকানিক্যাল শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গাড়ির গতিতে পরিণত হয়।

৪. আলোক শক্তি (Light Energy) থেকে কেমিক্যাল শক্তি (Chemical Energy)

  • উদাহরণ: গাছের পাতা সূর্যের আলো গ্রহণ করে ফটোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেমিক্যাল শক্তিতে রূপান্তরিত করে।

৫. কাইনেটিক শক্তি (Kinetic Energy) থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি (Electrical Energy)

  • উদাহরণ: একটি জেনারেটর যেখানে কাইনেটিক শক্তি বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

শক্তির রূপান্তরের উদাহরণসমূহ

  • মটরগাড়ি: জ্বালানি থেকে তাপ শক্তি এবং কাইনেটিক শক্তিতে রূপান্তর।
  • সোলার প্যানেল: সূর্যের আলো থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন।
  • বাতাসী জলপথ: বাতাসের গতির শক্তি থেকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর।

শক্তির রূপান্তরে হারানো শক্তি (Energy Loss)

শক্তি রূপান্তরের সময় সবসময় সঠিকভাবে ১০০% শক্তি উৎপন্ন হয় না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে কিছু শক্তি হারিয়ে যায়, যেমন তাপের আকারে। এই ক্ষতি এফিসিয়েন্সি বা কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

তাপগতির ক্ষতি

  • কীভাবে হারায়:
    যখন শক্তি কোন যন্ত্র বা যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়, তখন কিছু শক্তি তাপ আকারে হারিয়ে যায়, যা কার্যকারিতা কমায়।

উদাহরণ:

  • ইঞ্জিন: ডিজেল বা পেট্রোল ইঞ্জিনে শক্তি কিছুটা তাপ হিসেবে ক্ষতি হয়, যার কারণে মোটরগাড়ির কার্যকারিতা পূর্ণ হয় না।
  • বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি: বিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করার সময় কিছু শক্তি তাপ আকারে ক্ষতি হয়।

শক্তির রূপান্তরের বাস্তব প্রভাব

শক্তির দক্ষতা ও উন্নত প্রযুক্তি

  • উন্নত প্রযুক্তির বিকাশের ফলে শক্তির রূপান্তর কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।
  • যেমন: LED লাইট এর মাধ্যমে আলোর শক্তির রূপান্তর কার্যকারিতা অনেক বাড়ানো হয়েছে, ফলে কম শক্তি খরচে বেশি আলো পাওয়া যায়।
  • সোলার প্যানেলবায়ুশক্তি থেকে অধিক শক্তি উৎপাদন হচ্ছে, যা আমাদের জীবনে পরিবেশবান্ধব শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ভর ও শক্তির মাঝে সম্পর্ক: 

ভর (Mass):

ভর হলো বস্তুটির পরিমাণ বা মাপ যা তার কণার সংখ্যা এবং গঠনের উপর নির্ভর করে। ভর একটি মৌলিক প্রোপার্টি যা বস্তুটি কোনো বাহ্যিক শক্তির প্রভাবে পরিবর্তিত হয় না। ভর সাধারণত কিলোগ্রাম (kg) বা গ্রাম (g) এককে মাপা হয়।

শক্তি (Energy):

শক্তি হলো কোনো কাজ সম্পন্ন করার ক্ষমতা। শক্তি বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান—কাইনেটিক শক্তি (গতি শক্তি), পটেনশিয়াল শক্তি (স্থির শক্তি), তাপ শক্তি, আলোক শক্তি, কেমিক্যাল শক্তি ইত্যাদি। শক্তির পরিমাপ করা হয় জুল (Joule) এককে।

ভর ও শক্তির সম্পর্ক: আইনস্টাইনের E = mc² সমীকরণ

ভর ও শক্তির সম্পর্ক: আইনস্টাইনের E = mc² সমীকরণ

আলবার্ট আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc² শক্তি এবং ভরের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

  • E = শক্তি (Energy)
  • m = ভর (Mass)
  • c = আলোর গতি (Speed of Light)

এই সমীকরণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে একটি বস্তু বা কণার ভর এর মধ্যে বিপুল পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত থাকে। বিশেষ করে, যদি একটি বস্তু সম্পূর্ণভাবে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, তবে তার ভরের পরিমাণ এবং আলোর গতির বর্গের গুণফলে পাওয়া শক্তি অত্যন্ত বিশাল হবে।

এটাকে আরও সহজ করে বোঝা যায়:

  • যদি ১ কিলোগ্রাম (kg) বস্তু সম্পূর্ণরূপে শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, তবে তার শক্তির পরিমাণ হবে প্রায় 9 × 10¹⁶ জুল—এটা পৃথিবীজুড়ে বিপুল শক্তি উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত।
  • এটি বোঝায় যে ভর এবং শক্তির মধ্যে সম্পর্ক এমন, যেখানে একে অপরকে রূপান্তরিত করা সম্ভব এবং এই রূপান্তর বিপুল পরিমাণ শক্তি বা শক্তির মুক্তির কারণ হতে পারে।

রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভর ও শক্তির সম্পর্ক

রাসায়নিক বিক্রিয়া এক প্রকার শক্তির রূপান্তর প্রক্রিয়া যেখানে ভর সাধারণত শক্তির রূপে পরিবর্তিত হয়, যদিও ভরের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে। তবে, রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ছোট পরিমাণ শক্তি নিঃসৃত হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্যে শক্তির এই মুক্তি ভরের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত।

কেমিক্যাল শক্তি (Chemical Energy)

রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা হলো কেমিক্যাল শক্তি। এটি কণার মধ্যে শক্তির মজুত অবস্থান, যা মোলিকিউল বা পরমাণুর বন্ধন ভেঙে বা নতুন বন্ধন গঠন করে মুক্তি পায়। কেমিক্যাল শক্তি সঞ্চিত থাকে বন্ডিং শক্তির মধ্যে এবং যখন এই বন্ধন ভাঙে, তখন শক্তি মুক্ত হয়।

উদাহরণ: গ্যাসের দাহন প্রক্রিয়া

যখন গ্যাস (যেমন, মিথেন) অক্সিজেনের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে, তখন এটি আগুনের শক্তি উৎপন্ন করে:

CH₄ + 2O₂ → CO₂ + 2H₂O + শক্তি

এখানে, মিথেন (CH₄) ও অক্সিজেন (O₂) মোলিকিউল একত্রিত হয়ে কেমিক্যাল শক্তি উৎপন্ন করে, যা তাপ এবং আলোক শক্তি হিসেবে মুক্ত হয়।

  • এই রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভর অপরিবর্তিত থাকে, তবে শক্তির রূপান্তর ঘটে—এবং কিছু শক্তি পরিবেশে মুক্তি পায়।

নিউক্লিয়ার রূপান্তর ও শক্তির মুক্তি

নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াগুলিতে (পারমাণবিক বিক্রিয়া) ভর এবং শক্তির সম্পর্ক আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। এখানে, ছোট পরিমাণ ভর একত্রিত বা বিভাজিত হয়ে বিশাল পরিমাণ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

  • পারমাণবিক বিভাজন: পরমাণু বিভাজনের ফলে উৎপন্ন শক্তি মূলত ভরের ক্ষতি (mass defect) থেকে আসে, যেখানে পরমাণুর ভরের একটি অংশ শক্তিতে পরিণত হয়।
  • পারমাণবিক সংযোজন: সূর্যের শক্তি উৎপাদন ঘটে হাইড্রোজেন পরমাণু সংযোজনের মাধ্যমে, যেখানে দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হয়ে একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি মুক্ত হয়।

ভরের ক্ষতি এবং শক্তির মুক্তি: 

রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শক্তির মুক্তি:

রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শক্তির রূপান্তর ঘটে, তবে এটি সাধারণত ছোট পরিমাণে হয়। এই ক্ষেত্রে ভরের ক্ষতি খুবই নগণ্য, যা আমরা দেখতে পাই না।
উদাহরণ:

  • যখন কাঠ পোড়ানো হয়, তখন কাঠের কেমিক্যাল শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তবে ভরের ক্ষতি খুবই কম।

পারমাণবিক বিক্রিয়ায় শক্তির মুক্তি:

পারমাণবিক বিক্রিয়ায় ভরের ক্ষতি অনেক বেশি হতে পারে এবং বিশাল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়।
উদাহরণ:

  • পারমাণবিক ফিউশনপারমাণবিক ফিশন দুটি প্রক্রিয়া শক্তির বিপুল পরিমাণ মুক্তি ঘটায়, যেখানে ভরের ক্ষতি অনেক বেশি হয়।

ভর এবং শক্তির সম্পর্কের বাস্তব প্রয়োগ

১. মহাজাগতিক শক্তি উৎপাদন

মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহ এবং নক্ষত্রের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ভর ও শক্তির সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • উদাহরণ: সূর্য: সূর্যের শক্তি উৎপাদিত হয় হাইড্রোজেন পরমাণু সংযোজনের মাধ্যমে, যেখানে ভরের ক্ষতি ঘটে এবং শক্তির বিপুল পরিমাণ মুক্তি ঘটে।

২. পারমাণবিক শক্তি

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে পরমাণু বিভাজন ও সংযোজনের মাধ্যমে শক্তির উৎপাদন ঘটে। এখানে, ভরের একটি অংশ শক্তি রূপে রূপান্তরিত হয় এবং শক্তির সঞ্চালন ঘটে।

৩. জীববিজ্ঞানী প্রক্রিয়া

ফটোসিন্থেসিসের মতো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলিতে শক্তির রূপান্তর ঘটলেও এখানে ভরের ক্ষতি নেই, তবে শক্তির সঞ্চালন ঘটে।

ক্ষমতা কী?

কোনো ব্যক্তি বা যন্ত্র নির্দিষ্ট সময়ে যত কাজ সম্পন্ন করতে পারে, তাকে ক্ষমতা বলে।

ক্ষমতার সূত্র:

P = W x t

এখানে,

  • P = ক্ষমতা
  • W = সম্পন্ন করা কাজ
  • t = সময়

ক্ষমতার একক

ক্ষমতার এসআই একক ওয়াট (Watt), যা এক জুল কাজ এক সেকেন্ডে সম্পন্ন করার হার বোঝায়।

1 Watt=1 Joule/1 second

অন্যান্য ক্ষমতার একক

  • কিলোওয়াট (kW) = 1000 ওয়াট
  • অশ্বশক্তি (Horsepower, HP) = 746 ওয়াট

ক্ষমতার প্রকারভেদ

১. যান্ত্রিক ক্ষমতা (Mechanical Power)

  • যেকোনো যন্ত্র বা যানবাহনের ক্ষমতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
  • উদাহরণ: মোটরগাড়ি, ট্রেন, বিমান ইত্যাদির ইঞ্জিনের ক্ষমতা।

২. বিদ্যুৎ ক্ষমতা (Electrical Power)

  • বৈদ্যুতিক যন্ত্র কত দ্রুত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, তা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
  • উদাহরণ: বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্রিজ, টেলিভিশন ইত্যাদির ক্ষমতা ওয়াট বা কিলোওয়াটে প্রকাশ করা হয়।

৩. মানবশক্তি বা শারীরিক ক্ষমতা

  • একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ে কত কাজ করতে পারে, তা বোঝায়।
  • উদাহরণ: একজন কুলি কত দ্রুত মাল ওঠাতে পারে।

ক্ষমতা কিসের ওপর নির্ভর করে?

১. কাজের পরিমাণ: বেশি কাজ হলে বেশি ক্ষমতা দরকার হয়।
২. সময়ের পরিমাণ: কম সময়ে বেশি কাজ করলে বেশি ক্ষমতা প্রয়োজন হয়।
৩. যন্ত্র বা ব্যক্তির দক্ষতা: দক্ষ যন্ত্র বা ব্যক্তি কম সময়ে বেশি কাজ করতে পারে, তাই তাদের ক্ষমতা বেশি।

ক্ষমতার ব্যবহার

  • যান্ত্রিক কাজে: ইঞ্জিন, গাড়ি, বিমান, এবং যন্ত্রপাতির কার্যক্ষমতা নির্ণয়ে।
  • বিদ্যুৎ উৎপাদনে: বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত শক্তি পরিমাপে (যেমন কিলোওয়াট, মেগাওয়াট)।
  • গৃহস্থালির যন্ত্রে: ফ্রিজ, টিভি, এয়ার কন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিনের বিদ্যুৎ খরচ পরিমাপে।
  • শিল্প কারখানায়: উৎপাদনশীলতার জন্য যন্ত্রের কার্যক্ষমতা নির্ধারণে।
  • ক্রীড়া ও শারীরিক পরিশ্রমে: অ্যাথলেটদের শক্তি ও কর্মদক্ষতা মূল্যায়নে।
  • যোগাযোগ ও পরিবহনে: দ্রুতগামী ট্রেন, জাহাজ, এবং মহাকাশযানের কর্মক্ষমতা নির্ধারণে।
  • নবায়নযোগ্য শক্তিতে: সৌর প্যানেল, বায়ুকল, জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন ক্ষমতা নির্ণয়ে।
  • গবেষণা ও প্রযুক্তিতে: লেজার, সুপারকম্পিউটার, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কর্মদক্ষতা পরিমাপে।
Scroll to Top