তাপ ও তাপমাত্রা: 

তাপ কি?

তাপ কি?

তাপ হলো এক প্রকার শক্তি যা উষ্ণতর বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে স্থানান্তরিত হয় । এই শক্তি স্থানান্তর তখনই ঘটে যখন দুটি বস্তুর মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য বিদ্যমান থাকে। যদি দুটি ভিন্ন তাপমাত্রার বস্তুকে পরস্পরের সংস্পর্শে আনা হয়, তবে উষ্ণ বস্তু থেকে শীতল বস্তুর দিকে শক্তি প্রবাহিত হতে শুরু করে, এই শক্তি প্রবাহকেই তাপ প্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রার সমতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে । তাপ স্থানান্তর একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া যা সর্বদা উচ্চ তাপমাত্রাযুক্ত বস্তু থেকে নিম্ন তাপমাত্রাযুক্ত বস্তুর দিকে ধাবিত হয় ।  

এই তাপ শক্তি বিভিন্ন মাধ্যমে সঞ্চালিত হতে পারে। কঠিন বা স্থির তরলের ক্ষেত্রে পরিবহন (conduction) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাপ সঞ্চালিত হয়, যেখানে অণুগুলো সরাসরি একে অপরের সাথে ধাক্কা লাগার মাধ্যমে শক্তি হস্তান্তর করে । তরল বা গ্যাসের ক্ষেত্রে পরিচলন (convection) প্রক্রিয়ায় তাপ সঞ্চালিত হয়, যেখানে উষ্ণতর অংশ স্থানান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে তাপ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় । এছাড়াও, বিকিরণ (radiation) প্রক্রিয়ায় তাপ শক্তি স্থানান্তরিত হতে পারে, যার জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। সূর্য থেকে পৃথিবীতে তাপ আসা এই প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ ।  

তাপ গ্রহণ বা বর্জন করার ফলে শুধুমাত্র বস্তুর তাপমাত্রার পরিবর্তন হয় না, বরং এর ভৌত অবস্থারও পরিবর্তন ঘটতে পারে । উদাহরণস্বরূপ, কঠিন বরফ তাপ গ্রহণ করে তরল জলে পরিণত হতে পারে (গলন), অথবা তরল জল তাপ গ্রহণ করে গ্যাসীয় বাষ্পে পরিণত হতে পারে (বাষ্পীভবন)। কিছু ক্ষেত্রে, কঠিন পদার্থ সরাসরি গ্যাসীয় অবস্থায় পরিবর্তিত হতে পারে, যাকে ঊর্ধ্বপাতন বলা হয় । এই ভৌত অবস্থা পরিবর্তনের সময় বস্তুর তাপমাত্রা স্থির থাকে এবং এই সময়ে গৃহীত বা বর্জিত তাপ লীন তাপ (latent heat) নামে পরিচিত ।  

সাধারণভাবে, ‘তাপ’ শব্দটি উষ্ণতা বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও, বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তাপ হলো উষ্ণ বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে শক্তি প্রবাহের একটি প্রক্রিয়া । বিজ্ঞান ‘তাপ’ কে একটি নির্দিষ্ট ঘটনা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে যা কেবলমাত্র শক্তি স্থানান্তরের সময় বিদ্যমান থাকে, কোনো বস্তুর মধ্যে সঞ্চিত শক্তিকে তাপ বলা যায় না ।  

তাপমাত্রা কাকে বলে? 

তাপমাত্রা কাকে বলে?

তাপমাত্রা হলো কোনো বস্তুর তাপীয় অবস্থা যা নির্ধারণ করে কোন বস্তুর সংস্পর্শে আসলে তাপ গ্রহণ করবে নাকি বর্জন করবে।  এটি বস্তুর অণু বা পরমাণুগুলোর গড় গতিশক্তির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত । কোনো বস্তুর অণুগুলো যত দ্রুত গতিতে স্পন্দিত বা স্থানান্তরিত হয়, সেই বস্তুর তাপমাত্রা তত বেশি হয়। তাপমাত্রা একটি নিবিড় ধর্ম (intensive property), যার অর্থ হলো এটি বস্তুর পরিমাণের উপর নির্ভর করে না । উদাহরণস্বরূপ, এক কাপ গরম কফি এবং একটি বিশাল হিমবাহ একই তাপমাত্রা ধারণ করতে পারে, যদিও হিমবাহের মোট তাপ শক্তি কফির চেয়ে অনেক বেশি ।  

তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য থার্মোমিটার নামক যন্ত্র ব্যবহার করা হয় । থার্মোমিটারে বিভিন্ন তাপমাত্রার স্কেল অঙ্কন করা হয়, যার মধ্যে সেলসিয়াস (°C), ফারেনহাইট (°F), এবং কেলভিন (K) প্রধান ।  

তাপমাত্রা তাপ প্রবাহের দিক নির্ধারণ করে। তাপ সর্বদা উচ্চ তাপমাত্রার বস্তু থেকে নিম্ন তাপমাত্রার বস্তুর দিকে প্রবাহিত হয় । যখন দুটি বস্তু তাপীয় সাম্যাবস্থায় (thermal equilibrium) পৌঁছে, তখন তাদের তাপমাত্রা সমান হয় এবং তাদের মধ্যে আর কোনো নিট তাপ স্থানান্তর ঘটে না । তাপীয় সাম্যাবস্থা অর্জিত হওয়ার অর্থ হলো দুটি বস্তুর অণুগুলোর গড় গতিশক্তি সমান হয়েছে।  

তাপ ও তাপমাত্রার একক সমূহ

তাপের একক তাপের SI একক হলো জুল (J) পরিমাপের অন্য একক ক্যালোরি (cal)
তাপমাত্রার একক তাপমাত্রার SI একক হলো কেলভিন (K) পরিমাপের অন্য একক সেলসিয়াস (°C), এবং ফারেনহাইট (°F)

তাপ ও তাপমাত্রার মাঝে পার্থক্য:

তাপ তাপমাত্রা
তাপ হলো এক প্রকার শক্তি যা উষ্ণতর বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে স্থানান্তরিত হয় । এই শক্তি স্থানান্তর তখনই ঘটে যখন দুটি বস্তুর মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য বিদ্যমান থাকে তাপমাত্রা হলো কোনো বস্তুর তাপীয় অবস্থা যা নির্ধারণ করে কোন বস্তুর সংস্পর্শে আসলে তাপ গ্রহণ করবে নাকি বর্জন করবে
তাপের প্রবাহ তাপের পরিমানের উপর নির্ভর করে না তাপের প্রবাহ তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে 
তাপ হলো তাপমাত্রার কারন তাপমাত্রা হলো তাপের ফল
তাপ পরিমাপের একক জুল তাপমাত্রা পরিমাপের একক কেলভিন 
দুটি বস্তুর তাপমাত্রা একই হলেও তাপের পরিমান ভিন্ন হতে পারে  দুটি বস্তুর তাপের পরিমান একই হলেও তাপমাত্রার পরিমান ভিন্ন হতে পারে 
তাপ বস্তুস্হিত অণুর শক্তির সমানুপাতিক  তাপমাত্রা বস্তুস্হিত গড় শক্তির সমানুপাতিক 
তাপ পরিমাপক যন্ত্রের নাম ক্যালোরিমিটার তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্রের নাম থার্মোমিটার 

তাপমাত্রার বিভিন্ন স্কেলের মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করো:

তাপমাত্রার বিভিন্ন স্কেলের মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করো

পরম শূন্য তাপমাত্রা কাকে বলে?

পরম শূন্য তাপমাত্রা হল সেই তাপমাত্রা যেখানে কোনো বস্তুর অণু-পরমাণুর সব ধরনের গতি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এটি হলো 0 কেলভিন বা -273.15 ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এটি একটি তাত্ত্বিক তাপমাত্রা, কারণ বাস্তবে কোনো বস্তুকে একেবারে পরম শূন্যে আনা সম্ভব নয়।

পারদ থার্মোমিটারের গঠন (Structure of a Mercury Thermometer):

পারদ থার্মোমিটারের গঠন (Structure of a Mercury Thermometer)

একটি সাধারণ পারদ থার্মোমিটার প্রধানত নিম্নলিখিত অংশগুলো নিয়ে গঠিত:

কাঁচের নল (Glass Tube): এটি একটি সরু, সুষম ছিদ্রযুক্ত কাঁচের নল। নলের ভেতরের ছিদ্রটি খুবই সরু এবং একে কৈশিক নল (capillary tube) বলা হয়। এই নলটি সাধারণত পুরু কাঁচের তৈরি হয় যাতে সহজে ভেঙে না যায়।

পারদপূর্ণ বাল্ব (Mercury Bulb): নলের এক প্রান্ত একটি ছোট কাঁচের বাল্বের সাথে যুক্ত থাকে। এই বাল্বের ভেতরে বিশুদ্ধ পারদ (mercury) রাখা হয়। তাপমাত্রার পরিবর্তনে এই পারদের প্রসারণ বা সংকোচন ঘটে।

সংকোচন (Constriction): বাল্বের ঠিক উপরে, কৈশিক নলের মধ্যে একটি সামান্য বাঁকানো বা সংকুচিত অংশ থাকে। এই সংকোচনটির প্রধান কাজ হলো যখন থার্মোমিটার গরম কোনো বস্তু থেকে সরানো হয়, তখন পারদ দ্রুত বাল্বে ফিরে যাওয়া রোধ করা। এর ফলে থার্মোমিটার সরানোর পরেও সঠিক তাপমাত্রা পাঠ করা সম্ভব হয়।

মাপনী স্কেল (Graduated Scale): কাঁচের নলের গায়ে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা পরিসীমা (temperature range) চিহ্নিত করা থাকে। এই স্কেলটি সেলসিয়াস (°C) এবং/অথবা ফারেনহাইট (°F) এককে দাগাঙ্কিত করা থাকে। মানব দেহের তাপমাত্রা মাপার জন্য তৈরি থার্মোমিটারে সাধারণত ৩৫°C থেকে ৪২°C (অথবা ৯৫°F থেকে ১০৮°F) পর্যন্ত দাগাঙ্কন থাকে।

উপরের অংশ (Top End): নলের অন্য প্রান্তটি সাধারণত বন্ধ করা থাকে। এই অংশের ভেতরে সামান্য বাতাস অথবা শূন্যস্থান রাখা হয় যা উচ্চ তাপমাত্রায় পারদের প্রসারণের জন্য কিছুটা জায়গা করে দেয় এবং নল ফেটে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।

পারদ থার্মোমিটারের নির্মাণ প্রণালী (Construction Process of a Mercury Thermometer):

পারদ থার্মোমিটার তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:

কাঁচের নল তৈরি: প্রথমে একটি নির্দিষ্ট ভেতরের ব্যাসযুক্ত সরু কাঁচের নল তৈরি করা হয়। এই নলটি অবশ্যই সুষম ছিদ্রযুক্ত হতে হবে।

বাল্ব তৈরি: নলের এক প্রান্তে কাঁচ গলিয়ে একটি ছোট বাল্ব তৈরি করা হয়। বাল্বের আকার থার্মোমিটারের উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে।

সংকোচন তৈরি: বাল্বের ঠিক উপরে, কৈশিক নলের মধ্যে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সংকোচন তৈরি করা হয়। এই সংকোচনটি পারদের পশ্চাৎগতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পারদ ভর্তি: এরপর বাল্ব এবং কৈশিক নলের ভেতরের বাতাস বের করে নেওয়া হয় এবং বিশুদ্ধ পারদ প্রবেশ করানো হয়। পারদ এমনভাবে ভরা হয় যাতে তা বাল্ব এবং কৈশিক নলের একটি অংশ পূর্ণ করে।

উপরের প্রান্ত বন্ধ করা: পারদ ভর্তির পর নলের খোলা প্রান্ত উত্তপ্ত করে সিল করে দেওয়া হয়। এই সময় নলের ভেতরে সামান্য বাতাস অথবা প্রায় শূন্যস্থান রাখা হয়।

দাগাঙ্কন (Calibration): এটি থার্মোমিটার তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই ধাপে থার্মোমিটারটিকে দুটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সাথে তুলনা করে স্কেল তৈরি করা হয়:

  • হিমাঙ্ক নির্ধারণ: থার্মোমিটারটিকে গলন্ত বরফের মধ্যে রাখা হয় এবং পারদ যেখানে স্থির হয়, সেখানে ০°C (অথবা ৩২°F) দাগ দেওয়া হয়।
  • স্ফুটনাঙ্ক নির্ধারণ: এরপর থার্মোমিটারটিকে প্রমাণ চাপে ফুটন্ত জলের মধ্যে রাখা হয় এবং পারদ যেখানে স্থির হয়, সেখানে ১০০°C (অথবা ২১২°F) দাগ দেওয়া হয়।
  • মধ্যবর্তী দাগাঙ্কন: ০°C এবং ১০০°C (অথবা ৩২°F এবং ২১২°F) এর মধ্যবর্তী স্থানকে সমান ভাগে ভাগ করে অন্যান্য তাপমাত্রা নির্দেশক দাগগুলো তৈরি করা হয়।

পরীক্ষা ও গুণমান নিয়ন্ত্রণ: দাগাঙ্কনের পর প্রতিটি থার্মোমিটার সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা এবং সঠিক তাপমাত্রা দেখাচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। ত্রুটিপূর্ণ থার্মোমিটার বাতিল করা হয়।

এভাবেই একটি পারদ থার্মোমিটার তৈরি করা হয় যা তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য বহুল ব্যবহৃত একটি সরল যন্ত্র।

থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা:

থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা

পারদ ব্যবহারের সুবিধা:

  • উচ্চ তাপমাত্রার পরিমাপ: পারদের স্ফুটনাঙ্ক খুব বেশি (প্রায় ৩৫৭°C) হওয়ায় এটি উচ্চ তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য উপযোগী।
  • সুস্পষ্ট দৃশ্যমানতা: পারদ উজ্জ্বল এবং রৌপ্য বর্ণের হওয়ায় কাঁচের নলের মধ্যে এটি সহজেই দেখা যায় এবং তাপমাত্রা পাঠ করতে সুবিধা হয়।
  • নিয়মিত প্রসারণ: তাপমাত্রার সামান্য পরিবর্তনেও পারদের প্রসারণ ঘটে এবং এটি একটি নির্দিষ্ট হারে হয়। এর ফলে তাপমাত্রা সঠিকভাবে পাঠ করা যায়।
  • কাঁচের সাথে লেগে না থাকা: পারদ কাঁচের নলের ভেতরের দেওয়ালে লেগে থাকে না, তাই এটি অবাধে ওঠানামা করতে পারে এবং সঠিক তাপমাত্রা নির্দেশ করে।
  • দ্রুত তাপ গ্রহণ: পারদ খুব দ্রুত তাপ গ্রহণ করতে পারে, ফলে খুব কম সময়ে বস্তুর তাপমাত্রা মাপা যায়।
  • বিশুদ্ধতা: বিশুদ্ধ পারদ সহজে পাওয়া যায়।

পারদ ব্যবহারের অসুবিধা:

  • বিষাক্ত: পারদ একটি বিষাক্ত পদার্থ। থার্মোমিটার ভেঙে গেলে পারদ ছড়িয়ে গিয়ে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এর বাষ্প শ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে।
  • উচ্চ মূল্য: অন্যান্য থার্মোমিটারের তরলের তুলনায় পারদের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি।
  • নিম্ন তাপমাত্রা পরিমাপে অসুবিধা: পারদের হিমাঙ্ক বেশ উঁচু (-৩৯°C), তাই এটি খুব নিম্ন তাপমাত্রা মাপার জন্য উপযুক্ত নয়।
  • পরিবেশ দূষণ: থার্মোমিটার ভেঙে গেলে পারদ মাটিতে মিশে বা জলদূষণ ঘটিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। এটি জীববৈচিত্র্যের জন্যও ক্ষতিকর।
  • পঠনে অসুবিধা: কিছু ক্ষেত্রে পারদের ঔজ্জ্বল্যের কারণে সরাসরি আলোতে তাপমাত্রা পাঠ করতে অসুবিধা হতে পারে।

বর্তমানে পারদের বিষাক্ততার কারণে অনেক দেশেই এর ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে এবং এর বিকল্প হিসেবে অ্যালকোহল বা ডিজিটাল থার্মোমিটারের ব্যবহার বাড়ছে।

আপেক্ষিক তাপ, তাপধারণ ক্ষমতা ও পানিসম এর সংজ্ঞা এবং একক 

আপেক্ষিক তাপ (Specific Heat):

  • সংজ্ঞা: কোনো বস্তুর একক ভরের তাপমাত্রা এক কেলভিন (K) অথবা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস (°C) বৃদ্ধি করতে যে পরিমাণ তাপশক্তির প্রয়োজন হয়, তাকে ঐ বস্তুর উপাদানের আপেক্ষিক তাপ বলে।
  • সহজ ভাষায়, 1 kg ভরের কোনো পদার্থের তাপমাত্রা 1°C বাড়াতে যে তাপ লাগে, সেটাই হলো ঐ পদার্থের আপেক্ষিক তাপ।
  • একক: জুল প্রতি কেজি প্রতি কেলভিন (J kg⁻¹ K⁻¹) অথবা জুল প্রতি কেজি প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস (J kg⁻¹ °C⁻¹)। উভয় এককই ব্যবহার করা হয় কারণ তাপমাত্রার পার্থক্য কেলভিন এবং সেলসিয়াস স্কেলে সমান থাকে।

 তাপধারণ ক্ষমতা (Heat Capacity):

  • সংজ্ঞা: কোনো বস্তুর তাপমাত্রা এক কেলভিন (K) অথবা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস (°C) বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় মোট তাপের পরিমাণকে ঐ বস্তুর তাপধারণ ক্ষমতা বলে। এখানে বস্তুর ভরের কোনো উল্লেখ থাকে না, এটি সম্পূর্ণ বস্তুর বৈশিষ্ট্য।
  • সহজ ভাষায়, একটি নির্দিষ্ট বস্তুর তাপমাত্রা 1°C বাড়াতে যে পরিমাণ তাপ লাগে, সেটাই হলো ঐ বস্তুর তাপধারণ ক্ষমতা।
  • একক: জুল প্রতি কেলভিন (J K⁻¹) অথবা জুল প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস (J °C⁻¹)।

আপেক্ষিক তাপ ও তাপধারণ ক্ষমতার মধ্যে সম্পর্ক:

তাপধারণ ক্ষমতা (C) = বস্তুর ভর (m) × আপেক্ষিক তাপ (s)

                        বা C=ms​

পানিসম (Water Equivalent):

  • সংজ্ঞা: কোনো বস্তুর পানিসম হলো সেই পরিমাণ জলের ভর, যার তাপমাত্রা ঐ বস্তুর তাপমাত্রার সমান পরিমাণ বৃদ্ধি করতে ঠিক ততখানি তাপশক্তির প্রয়োজন হয় যতখানি ঐ বস্তুটির তাপমাত্রা একই পরিমাণ বৃদ্ধি করতে প্রয়োজন।
  • সহজ ভাষায়, কোনো বস্তুকে যতখানি তাপ দিলে তার তাপমাত্রা 1°C বাড়ে, ঠিক ততখানি তাপ কত ভরের জলের তাপমাত্রাও 1°C বাড়াতে পারবে, সেই জলের ভরই হলো বস্তুটির পানিসম।
  • পানিসমের ধারণা মূলত ক্যালোরিমিটারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ক্যালোরিমিটার এবং এর ভেতরের জল একই তাপমাত্রায় পরিবর্তিত হয়।
  • একক: কিলোগ্রাম (kg) অথবা গ্রাম (g)। এটি ভরের একক কারণ পানিসম আসলে জলের একটি সমতুল্য ভর।

বিভিন্ন ধরনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ:

গলনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ (Specific Latent Heat of Fusion):

  • সংজ্ঞা: স্থির তাপমাত্রায় একক ভরের কোনো কঠিন পদার্থকে সম্পূর্ণরূপে তরলে পরিণত করতে যে পরিমাণ তাপশক্তির প্রয়োজন হয়, তাকে ঐ পদার্থের গলনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ বলে। এই সময় পদার্থের তাপমাত্রার কোনো পরিবর্তন হয় না, কেবল অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
  • সহজ ভাষায়, 1 kg ভরের কোনো কঠিন পদার্থকে তার গলনাঙ্কে তরলে পরিণত করতে যে তাপ লাগে, সেটাই হলো ঐ পদার্থের গলনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ।
  • একক: জুল প্রতি কিলোগ্রাম (J kg⁻¹)।

উদাহরণস্বরূপ, 0°C তাপমাত্রার 1 kg বরফকে 0°C তাপমাত্রার পানিতে পরিণত করতে 3.36 × 10⁵ জুল তাপশক্তির প্রয়োজন হয়। সুতরাং বরফের গলনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ হলো 3.36 × 10⁵ J kg⁻¹।

বাষ্পীভবনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ (Specific Latent Heat of Vaporization):

  • সংজ্ঞা: স্থির তাপমাত্রায় একক ভরের কোনো তরল পদার্থকে সম্পূর্ণরূপে বাষ্পে পরিণত করতে যে পরিমাণ তাপশক্তির প্রয়োজন হয়, তাকে ঐ পদার্থের বাষ্পীভবনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ বলে। এই ক্ষেত্রেও পদার্থের তাপমাত্রার কোনো পরিবর্তন হয় না, কেবল অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
  • সহজ ভাষায়, 1 kg ভরের কোনো তরল পদার্থকে তার স্ফুটনাঙ্কে বাষ্পে পরিণত করতে যে তাপ লাগে, সেটাই হলো ঐ পদার্থের বাষ্পীভবনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ।
  • একক: জুল প্রতি কিলোগ্রাম (J kg⁻¹)।

উদাহরণস্বরূপ, 100°C তাপমাত্রার 1 kg পানিকে 100°C তাপমাত্রার জলীয় বাষ্পে পরিণত করতে 2.26 × 10⁶ জুল তাপশক্তির প্রয়োজন হয়। সুতরাং পানির বাষ্পীভবনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ হলো 2.26 × 10⁶ J kg⁻¹।

এছাড়াও, কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে আরও এক ধরনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ আলোচনা করা হয়:

৩. ঊর্ধ্বপাতনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ (Specific Latent Heat of Sublimation):

  • সংজ্ঞা: স্থির তাপমাত্রায় একক ভরের কোনো কঠিন পদার্থকে সরাসরি বাষ্পে পরিণত করতে যে পরিমাণ তাপশক্তির প্রয়োজন হয়, তাকে ঐ পদার্থের ঊর্ধ্বপাতনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ বলে। এক্ষেত্রে তরল অবস্থা মধ্যবর্তী ধাপ হিসেবে থাকে না।
  • একক: জুল প্রতি কিলোগ্রাম (J kg⁻¹)।

যেমন, কঠিন কর্পূরকে উত্তপ্ত করলে তা সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় তাপ হলো কর্পূরের ঊর্ধ্বপাতনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপ।

মূলত গলন এবং বাষ্পীভবনের আপেক্ষিক সুপ্ততাপই বহুলভাবে আলোচিত এবং ব্যবহৃত হয়। ঊর্ধ্বপাতনের ক্ষেত্রে পদার্থের সরাসরি কঠিন থেকে গ্যাসীয় অবস্থায় পরিবর্তন তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়।

প্রমান করো যে, মোট তাপ = বস্তুর ভর × আপেক্ষিক তাপ ×তাপমাত্রার পার্থক্য

ধরি,

  • কোনো বস্তুর ভর = m
  • বস্তুটির উপাদানের আপেক্ষিক তাপ = s
  • বস্তুটির প্রাথমিক তাপমাত্রা = T1
  • বস্তুটির চূড়ান্ত তাপমাত্রা = T2

আমরা জানি, কোনো বস্তুর তাপমাত্রা পরিবর্তন করতে প্রয়োজনীয় তাপ Q নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে:

১. বস্তুর ভর m: বস্তুর ভর যত বেশি হবে, তার তাপমাত্রা একই পরিমাণ পরিবর্তন করতে তত বেশি তাপের প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ, Q ∝ m   [যদি s এবং তাপমাত্রার পার্থক্য স্থির থাকে]

২. বস্তুর উপাদানের আপেক্ষিক তাপ s: বিভিন্ন পদার্থের আপেক্ষিক তাপ বিভিন্ন হয়। যে পদার্থের আপেক্ষিক তাপ যত বেশি, তার তাপমাত্রা একক পরিমাণ বৃদ্ধি করতে তত বেশি তাপের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ, Q ∝ s    [যদি (m) এবং তাপমাত্রার পার্থক্য স্থির থাকে]

৩. তাপমাত্রার পার্থক্য (T2 -T1) : তাপমাত্রার পার্থক্য যত বেশি হবে, বস্তুর তাপমাত্রার পরিবর্তন করতে তত বেশি তাপের প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ, Q ∝ (T2 -T1)     [যদি (m) এবং (s) স্থির থাকে]

এই তিনটি সম্পর্ককে একত্রিত করে আমরা লিখতে পারি:   

    Q ∝ m×s×(T2 -T1) 

বা,Q=k×m×s×(T2 -T1)

বা, Q= m×s×(T2 -T1) [k = 1]

অতএব,Q= ms(T2 -T1)

সুতরাং, প্রমাণিত হলো যে, মোট তাপ = বস্তুর ভর × আপেক্ষিক তাপ × তাপমাত্রার পার্থক্য

মিশ্রণ পদ্ধতিতে বরফ গলনের সুপ্ততাপ নির্ণয় করো। 

মিশ্রণ পদ্ধতিতে বরফ গলনের সুপ্ততাপ নির্ণয় করো। 

কার্যপ্রণালি: বরফ গলনের সুপ্ততাপ নির্ণয় করার জন্য প্রথমে একটি নাড়ানিসহ শুষ্ক ও পরিষ্কার ক্যালরিমিটার নিই এবং ভর নির্ণয় করি । এখন এই ক্যালরিমিটারে কিছু পানি নিই এবং ভর নির্ণয় করি। এই দুই ভরের পার্থক্য হতে পানির ভর পাওয়া যাবে। ক্যালরিমিটারকে একটি তাপ নিরোধী বাক্সের মধ্যে রেখে একটি সুবেদী থার্মোমিটার দ্বারা তাপমাত্রা নির্ণয় করি।

এখন কয়েক টুকরা বরফকে ব্লটিং কাগজ দিয়ে শুষ্ক করে দ্রুত ক্যালরিমিটারে নিমজ্জিত করি এবং জালিকাযুক্ত নাড়ানি দ্বারা বরফ পানিতে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত রাখি। তবে সাবধান থাকতে হবে যেন বরফ খণ্ড ভেসে না উঠে। সমস্ত বরফ গলে গেলে একটি সুবেদী থার্মোমিটার দ্বারা তাপমাত্রা নির্ণয় করি । এবার নাড়ানিসহ ক্যালরিমিটারের ভর নির্ণয় করি। তৃতীয় ভর হতে দ্বিতীয় ভর বিয়োগ করে বরফের ভর নির্ণয় করা হয়।

হিসাব: ধরি, বরফ গলনের সুপ্ততাপ = L  cal/gm

নাড়ানিসহ ক্যালরিমিটারের ভর = m1 gm

পানির ভর = m2 gm

বরফের ভর = m3 gm

ক্যালরিমিটারের উপাদানের আপেক্ষিক তাপ = S1

পানির আপেক্ষিক তাপ = S2   cal/gm/°C

নাড়ানিসহ ক্যালরিমিটার ও পানির তাপমাত্রা = t1

বরফের তাপমাত্রা = t2

শেষ তাপমাত্রা = t

0° সেলসিয়াস তাপমাত্রার বরফ, O°C এর পানিতে রূপান্তর হতে শোষিত তাপ,          Q 1 = m3L

0° সেলসিয়াস তাপমাত্রার বরফ গলা পানি,t°C এর পানিতে রূপান্তর হতে শোষিত তাপ Q 2= m3S2 (t – 0)

 ক্যালোরিমিটারের বর্জিত তাপ Q3 = m1S1 (t – t1 )

পানির বর্জিত তাপ Q 4 = m2 S2 ( t – t1 )

ক্যালোরিমিতির মূলনীতি অনুযায়ী, শোষিত তাপ = বর্জিত তাপ 

Q 1+ Q 2 = Q 3 +  Q 4

বা, m3L +  m3S2 (t – 0) = m1S1 (t – t1 ) + m2 S2 ( t – t1 )

বা,m3(L + t) = (t – t1 )(m1S1+ m2 )

  L =[ (t – t1 )(m1S1+ m2 ) / m3] – t

ইহাই বরফ গলনের সুপ্ততাপের রাশিমালা। 

-10° সেলসিয়াস তাপমাত্রার 100 গ্রাম বরফকে 100° সেলসিয়াস তাপমাত্রার বাষ্পে পরিণত করতে কত তাপের দরকার হবে?  ( বরফের আপেক্ষিক তাপ =0.5, বরফ গলনের সুপ্ততাপ =80 ক্যালরি /গ্রাম। পানির বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ =537 ক্যালরি/ গ্রাম) 

দেওয়া আছে, 

বরফের ভর m = 100gm

বরফের আপেক্ষিক তাপ S = 0.5

বরফ গলনের সুপ্ততাপ L =80 cal / gm

পানির বাষ্পীভবনের সুপ্ততাপ L1 =537 cal / gm

-10° সেলসিয়াস তাপমাত্রার বরফকে 0° সেলসিয়াস তাপমাত্রার বরফে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় তাপ  Q 1 = msΔT = 100 x 0.5 x ( 0-(-10)) = 500 cal

0° সেলসিয়াস তাপমাত্রার বরফকে 0° সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় তাপ Q 2 = mL = 100×80 = 8000 cal

0° সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিকে100° সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় তাপ Q 3 = mS1 ΔT = 100 x 1 x (100-0)= 10000 cal

100° সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিকে 100° সেলসিয়াস তাপমাত্রার বাষ্পে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় তাপ Q 4 = mL1 = 100 x 537 = 53700 cal

মোট প্রয়োজনীয় তাপ=Q 1 + Q 2 + Q 3+ Q 4 = 500 + 8000 + 10000 + 53700 = 72200 cal

 

Scroll to Top