আধান কাকে বলে?

আধান হলো পদার্থের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য যা নির্ধারণ করে যে এটি কোনো বৈদ্যুতিক বা চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সাথে কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করবে। অন্যভাবে বলা যায়, পদার্থ সৃষ্টিকারি মৌলিক কণা সমূহের বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্মকে আধান বা চার্জ বলে।   সেই ভৌত ধর্ম যা কোনো তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রে স্থাপন করলে ঐ পদার্থ শক্তি অনুভব করে।

সহজ ভাষায়, পরমাণুর মধ্যে থাকা ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হলেই আধানের উদ্ভব হয়।

আধান দুই প্রকার:

  • ধনাত্মক আধান: যখন কোনো বস্তুতে প্রোটনের সংখ্যা ইলেকট্রনের চেয়ে বেশি থাকে, তখন বস্তুটিতে ধনাত্মক আধান রয়েছে বলে ধরা হয়।
  • ঋণাত্মক আধান: যখন কোনো বস্তুতে ইলেকট্রনের সংখ্যা প্রোটনের চেয়ে বেশি থাকে, তখন বস্তুটিতে ঋণাত্মক আধান রয়েছে বলে ধরা হয়।

আধানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য:

  • আকর্ষণ ও বিকর্ষণ: সমধর্মী আধান (যেমন: ধনাত্মক-ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক-ঋণাত্মক) পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীতধর্মী আধান (যেমন: ধনাত্মক-ঋণাত্মক) পরস্পরকে আকর্ষণ করে।
  • সংরক্ষণ: আধান সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, কেবল এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে স্থানান্তর করা যায়। কোনো বিচ্ছিন্ন সিস্টেমে মোট আধান সবসময় ধ্রুব থাকে।
  • কোয়ান্টায়িত: আধান একটি বিচ্ছিন্ন রাশি। এর অর্থ হলো যেকোনো বস্তুর আধান একটি নির্দিষ্ট ক্ষুদ্রতম আধানের পূর্ণ গুণিতক হবে। এই ক্ষুদ্রতম আধানটি হলো একটি ইলেকট্রনের আধান, যার মান প্রায় 1.602×10−19 কুলম্ব।
  • স্কেলার রাশি: আধানের কোনো দিক নেই, কেবল মান রয়েছে।
  • একক: আধানের এসআই একক হলো কুলম্ব (C)।

কুলম্বের সূত্র বিবৃতি ও ব্যাখ্যা করো।

কুলম্বের সূত্র: বিবৃতি

দুটি স্থির বিন্দু আধানের মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল আধানদ্বয়ের পরিমাণের গুণফলের  সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এই বল আধানদ্বয়ের সংযোগ সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে এবং মাধ্যমের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।

কুলম্বের সূত্র বিবৃতি ও ব্যাখ্যা করো।

কুলম্বের সূত্রের ব্যাখ্যা:

ধরা যাক, দুটি বিন্দু আধান q1 এবং q2​ পরস্পর থেকে r দূরত্বে অবস্থিত। কুলম্বের সূত্রানুসারে, এদের মধ্যে ক্রিয়াশীল বল (F) নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভরশীল:

১. আধানের পরিমাণ: বল আধানদ্বয়ের পরিমাণের গুণফলের সরাসরি সমানুপাতিক। অর্থাৎ, যদি আধানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তবে বলের মানও বৃদ্ধি পায়। গাণিতিকভাবে এটিকে এভাবে লেখা যায়:

F∝∣q1q2​∣

এখানে ∣q1​∣ এবং ∣q2​∣ হলো আধান দুটির পরম মান।

২. মধ্যবর্তী দূরত্ব: বল আধানদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ, যদি দূরত্ব বৃদ্ধি পায়, তবে বলের মান দ্রুত হ্রাস পায়। গাণিতিকভাবে এটিকে এভাবে লেখা যায়:

F ∝ r2

৩. মাধ্যমের প্রকৃতি: দুটি আধানের মধ্যে যে মাধ্যম (যেমন: বায়ু, শূন্যস্থান, তেল, ইত্যাদি) থাকে, তার প্রকৃতির উপরও বলের মান নির্ভর করে। এই প্রভাব একটি ধ্রুবকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।

এই তিনটি বিষয়কে একত্রিত করে কুলম্বের সূত্রটিকে একটি গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়:

এখানে k একটি সমানুপাতিক ধ্রুবক, যার মান আধানের একক এবং মধ্যবর্তী মাধ্যমের উপর নির্ভর করে।

এসআই (SI) পদ্ধতিতে শূন্যস্থান বা বায়ুর ক্ষেত্রে k এর মান হলো:

k= 1 / 4πϵ0 ​≈ 8.9875×109 Nm2C-2

যেখানে ϵ0​হলো শূন্যস্থানের ভেদনযোগ্যতা (permittivity of free space), যার মান প্রায় 8.854×10-12C2N-1m-2

কুলম্বের সংজ্ঞা দাও। 

কুলম্ব (Coulomb) হলো আন্তর্জাতিক একক পদ্ধতিতে (SI) বৈদ্যুতিক আধানের একক। একে ‘C’ প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

সহজ ভাষায়, এক কুলম্ব হলো সেই পরিমাণ বৈদ্যুতিক আধান যা এক অ্যাম্পিয়ার তড়িৎ প্রবাহ এক সেকেন্ড ধরে কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলে স্থানান্তরিত হয়।

অন্যভাবে বলা যায়, দুটি সমপরিমাণ বিন্দু আধানকে বায়ু বা শূন্য মাধ্যমে পরস্পর থেকে 1 মিটার দূরত্বে স্থাপন করলে যদি এদের মধ্যে 9×109 নিউটন বিকর্ষণ বল ক্রিয়া করে, তাহলে প্রত্যেকটি আধানের পরিমাণকে এক কুলম্ব বলা হয়। এই সংজ্ঞাটি কুলম্বের সূত্রের উপর ভিত্তি করে তৈরি।

গাণিতিকভাবে, আধান Q = তড়িৎ প্রবাহ I × সময় t সুতরাং, 1 কুলম্ব = 1 অ্যাম্পিয়ার × 1 সেকেন্ড।

তড়িৎ ক্ষেত্র (Electric Field):

কোনো আধান বা আধানসমষ্টির চারপাশে যে অঞ্চল জুড়ে ঐ আধান বা আধানসমষ্টি অন্য কোনো আধানিত বস্তুর উপর আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল প্রয়োগ করতে পারে, সেই অঞ্চলকে তড়িৎ ক্ষেত্র বলে।

সহজ ভাষায়, একটি চার্জিত বস্তুর আশেপাশে যে স্থানে অন্য কোনো চার্জিত বস্তু আনলে তা একটি বল অনুভব করে, সেই স্থানটিই হলো প্রথম চার্জিত বস্তুর তড়িৎ ক্ষেত্র। তড়িৎ ক্ষেত্র একটি ভেক্টর রাশি, কারণ এর মান এবং দিক উভয়ই রয়েছে।

তড়িৎ ক্ষেত্র (Electric Field)

তড়িৎ প্রাবল্য (Electric Field Intensity/Strength):

তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে একটি একক ধনাত্মক আধান স্থাপন করলে সেটি যে বল অনুভব করে, সেই বলকে ঐ বিন্দুর তড়িৎ প্রাবল্য বলে।

তড়িৎ প্রাবল্য একটি ভেক্টর রাশি। এর দিক সেই দিকে হয় যে দিকে একক ধনাত্মক আধানটি বল অনুভব করে। যদি কোনো তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে q পরিমাণ আধান স্থাপন করলে F বল অনুভব করে, তবে ঐ বিন্দুতে তড়িৎ প্রাবল্য E হবে:

E=F/q

তড়িৎ প্রাবল্যের এসআই একক হলো নিউটন প্রতি কুলম্ব (N/C) অথবা ভোল্ট প্রতি মিটার (V/m)।

তড়িৎ বিভব (Electric Potential):

কোনো একক ধনাত্মক আধানকে অসীম দূরত্ব থেকে তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে আনতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়, তাকে ঐ বিন্দুর তড়িৎ বিভব বলে।

তড়িৎ বিভব (Electric Potential)

তড়িৎ বিভব একটি স্কেলার রাশি, কারণ এর কেবল মান আছে, কোনো নির্দিষ্ট দিক নেই। যদি অসীম দূরত্ব থেকে q পরিমাণ আধানকে তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে আনতে W পরিমাণ কাজ করতে হয়, তবে ঐ বিন্দুর তড়িৎ বিভব V হবে:

V=W​/q

তড়িৎ বিভবের এসআই একক হলো ভোল্ট (V), যা জুল প্রতি কুলম্ব (J/C) এর সমান।

সংক্ষেপে:

  1. তড়িৎ ক্ষেত্র: আধানের চারপাশের প্রভাব অঞ্চল।
  2. তড়িৎ প্রাবল্য: তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে একক ধনাত্মক আধানের উপর প্রযুক্ত বল।
  3. তড়িৎ বিভব: অসীম থেকে একক ধনাত্মক আধানকে তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে আনতে কৃত কাজ।

তড়িৎ প্রাবল্য ও বিভবের মাঝে সম্পর্ক স্হাপন করো

ধরা যাক, তড়িৎ ক্ষেত্রের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র ধনাত্মক আধান dq কে একটি বিন্দু থেকে অন্য একটি বিন্দুতে dl সরাতে dW পরিমাণ কাজ করতে হয়। তাহলে, বিভবের সংজ্ঞা অনুযায়ী, এই কাজের পরিমাণ হবে:

dW = −dq⋅dV

এখানে ঋণাত্মক চিহ্নটি নির্দেশ করে যে আধানটিকে বিভব বৃদ্ধির বিপরীতে সরানো হচ্ছে।

আবার, তড়িৎ প্রাবল্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী, dq আধানের উপর তড়িৎ বল হবে: F = dqE

এই বলের বিরুদ্ধে dl সরাতে কৃত কাজ হলো:

dW= −F⋅dl = −dqE⋅dl

সুতরাং, আমরা লিখতে পারি:

−dq⋅dV = −dqE⋅dl

উভয় পক্ষ থেকে dq বাদ দিলে পাই:

dV = E⋅dl

এই সমীকরণটি একটি ক্ষুদ্র সরণের জন্য তড়িৎ প্রাবল্য এবং বিভবের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে।

ধারক কি? ধারকের সঞ্চিত শক্তির রাশিমালা প্রতিপাদন করো। 

ধারক কি? ধারকের সঞ্চিত শক্তির রাশিমালা প্রতিপাদন করো

ধারক (Capacitor) হলো একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ যা বৈদ্যুতিক শক্তি বা আধান সঞ্চয় করতে পারে। এটি মূলত দুটি পরিবাহী পাত বা প্লেট এবং তাদের মধ্যে একটি অন্তরক (dielectric) পদার্থ নিয়ে গঠিত। যখন এই পাত দুটির মধ্যে বিভব পার্থক্য স্থাপন করা হয়, তখন পাতগুলোতে সমান ও বিপরীত আধান জমা হয় এবং তড়িৎক্ষেত্র তৈরি হয়। এই তড়িৎক্ষেত্রের মাধ্যমেই ধারকে শক্তি সঞ্চিত থাকে।

Structure of Capacitor

ধারকের সঞ্চিত শক্তির রাশিমালা প্রতিপাদন:

মোট আধান 0 থেকে Q পর্যন্ত সঞ্চিত করতে কৃত মোট কাজ নির্ণয়ের জন্য আমরা এই ক্ষুদ্র কাজটিকে সমাকলন 

এই কৃত কাজই ধারকের মধ্যে স্থিতিশক্তি (U) রূপে সঞ্চিত থাকে।

ধারকের ব্যবহার আলোচনা করো।

ধারকের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার আলোচনা করা হলো:

১. বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চয়:

  • ধারকের প্রধান কাজ হলো বৈদ্যুতিক শক্তি বা আধান সঞ্চয় করা। এটি খুব অল্প সময়ের জন্য প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমা করতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারে।
  • ক্যামেরা ফ্ল্যাশে, লেজার ডিভাইসে এবং অন্যান্য পালস পাওয়ার অ্যাপ্লিকেশনে এটি ব্যবহৃত হয়।

২. ফিল্টার হিসেবে ব্যবহার:

  • ধারক পরিবর্তী প্রবাহকে (AC) সহজে প্রবাহিত হতে দেয় কিন্তু একমুখী প্রবাহকে (DC) বাধা দেয়। এই কারণে এটি বৈদ্যুতিক বর্তনীতে ফিল্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
  • পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিটে AC থেকে DC করার সময় অবশিষ্ট AC উপাদান ছেঁকে ফেলতে ধারক ব্যবহার করা হয়।
  • বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সার্কিটে অবাঞ্ছিত নয়েজ বা সংকেত দূর করতে এটি ব্যবহৃত হয়।

৩. কাপলিং এবং ডিকাপলিং:

  • অডিও অ্যামপ্লিফায়ারের মতো সার্কিটে একটি অংশ থেকে অন্য অংশে শুধুমাত্র AC সংকেত পাঠানোর জন্য এবং DC বায়াসিংকে আলাদা করার জন্য ধারক ব্যবহার করা হয়। একে কাপলিং বলে।
  • ইলেকট্রনিক যন্ত্রের বিভিন্ন অংশে স্থিতিশীল ভোল্টেজ সরবরাহ করার জন্য এবং নয়েজ কমানোর জন্য ডিকাপলিং ক্যাপাসিটর ব্যবহার করা হয়।

৪. টাইমিং সার্কিট:

  • ধারক এবং রোধকের সমন্বয়ে গঠিত RC সার্কিট টাইমিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। চার্জিং এবং ডিসচার্জিংয়ের সময়কে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে নির্দিষ্ট সময় অন্তর কাজ করার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।
  • যেমন: ফ্ল্যাশিং লাইট, টাইমার, অসিলিটর ইত্যাদি।

৫. টিউনিং সার্কিট:

  • রেডিও এবং টেলিভিশনের টিউনিং সার্কিটে পরিবর্তনশীল ধারক ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির বেতার তরঙ্গ নির্বাচন করা যায়।

৬. পাওয়ার ফ্যাক্টর সংশোধন:

  • ইন্ডাক্টিভ লোড (যেমন মোটর, ট্রান্সফরমার) যুক্ত AC পাওয়ার সিস্টেমে পাওয়ার ফ্যাক্টর উন্নত করার জন্য ধারক ব্যবহার করা হয়।

৭. সেন্সিং:

  • কিছু বিশেষ ধরনের ধারক যেমন ক্যাপাসিটিভ সেন্সর স্পর্শ, চাপ, আর্দ্রতা, এবং সান্নিধ্য সনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। টাচস্ক্রিন এর একটি উদাহরণ।

৮. মোটর স্টার্টার:

  • কিছু বৈদ্যুতিক মোটর চালু করার জন্য অতিরিক্ত টর্কের প্রয়োজন হয়। এই কারণে কিছু মোটরের সাথে স্টার্ট ক্যাপাসিটর ব্যবহার করা হয়।

সংক্ষেপে, ধারক আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের একটি অপরিহার্য উপাদান এবং বিভিন্ন বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির কার্যকারিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Scroll to Top