প্রত্যাগামী প্রক্রিয়া (Reversible Process) হলো সেই প্রক্রিয়া যা বিপরীত দিকে চালিত হতে পারে এবং সম্মুখবর্তী ও বিপরীতমুখী উভয় প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে সিস্টেম এবং পরিবেশ তাদের পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়াগুলি অত্যন্ত ধীরে ধীরে সম্পন্ন হয় এবং কোন অপচয়কারী শক্তি (যেমন ঘর্ষণ, সান্দ্রতা) জড়িত থাকে না। সহজভাষায়,যে প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এমনভাবে ঘটে যে, উপযুক্ত শর্তে তা আগের অবস্থায় পুরোপুরি ফিরে যেতে পারে, তাকে প্রত্যাগামী প্রক্রিয়া বলে।
বাস্তবে, সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাগামী প্রক্রিয়া পাওয়া কঠিন, তবে কিছু প্রক্রিয়া যেমন স্থিতিস্থাপক বস্তুর ধীরে ধীরে প্রসারণ বা সংকোচন, অথবা বরফ ধীরে ধীরে গলে পানিতে পরিণত হওয়া এবং পানি ধীরে ধীরে জমে বরফ হওয়াকে আপাতভাবে প্রত্যাগামী বলা যেতে পারে।
উদাহরণ:
গ্যাসের সংকোচন ও সম্প্রসারণ
বরফ ↔ পানি (উপযুক্ত তাপমাত্রায়)
রাসায়নিক বিক্রিয়া:
N2+3H2 ⇌ 2NH3
(এই বিক্রিয়ায় অ্যামোনিয়া গঠনের পাশাপাশি আবার ভাঙতেও পারে)
বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
ধীরে ধীরে ঘটে
সাম্যাবস্থায় পৌঁছায়
সিস্টেম ও আশেপাশে পরিবর্তন কম হয়
অপ্রত্যাগামী প্রক্রিয়া (Irreversible Process):
অপ্রত্যাগামী প্রক্রিয়া (Irreversible Process) হলো সেই প্রক্রিয়া যা বিপরীত দিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চালিত হতে পারে না। এই প্রক্রিয়াগুলি সাধারণত দ্রুত ঘটে এবং অপচয়কারী শক্তি জড়িত থাকে, যার ফলে সিস্টেম এবং পরিবেশ তাদের একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না। প্রকৃতির বেশিরভাগ প্রক্রিয়া অপ্রত্যাগামী। সহজভাষায়, যে প্রক্রিয়ায় একবার পরিবর্তন ঘটে গেলে তা আর আগের অবস্থায় সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, তাকে অপ্রত্যাগামী প্রক্রিয়া বলে।
উদাহরণ:
কাগজ পোড়ানো
দুধ ফেটে যাওয়া
হাওয়া ভর্তি বেলুন ফেটে যাওয়া
রাসায়নিক বিক্রিয়া:
C+O2→CO2 (এই বিক্রিয়ায় CO₂ একবার তৈরি হলে আবার সহজে আগের অবস্থায় ফেরা যায় না)
বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
দ্রুত ঘটে
সাম্যাবস্থায় পৌঁছায় না
পরিবেশে শক্তি হারিয়ে যায়
প্রত্যাগামী ও অপ্রত্যাগামী প্রক্রিয়ার মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করো
প্রত্যাগামী প্রক্রিয়া (Reversible Process)
অপ্রত্যাগামী প্রক্রিয়া (Irreversible Process)
একটি আদর্শ প্রক্রিয়া, বাস্তবে খুব কমই দেখা যায়।
বাস্তব প্রক্রিয়া, প্রকৃতিতে প্রায় সবসময়ই ঘটে।
অসীম ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়, প্রতিটি ধাপে সাম্যাবস্থা বজায় থাকে।
তুলনামূলকভাবে দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হয়, সাম্যাবস্থা নাও থাকতে পারে।
বিপরীত দিকে চালিত করে সিস্টেম এবং পরিবেশকে তাদের প্রাথমিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, কোনো স্থায়ী পরিবর্তন হয় না।
বিপরীত দিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চালিত করা যায় না এবং সিস্টেম ও পরিবেশকে প্রাথমিক অবস্থায় ফেরাতে কিছু স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে।
কোনো শক্তি অপচয় হয় না (যেমন ঘর্ষণ, সান্দ্রতা)।
শক্তি অপচয় হয় (যেমন তাপ উৎপন্ন হওয়া, ঘর্ষণ)।
তাত্ত্বিকভাবে অসীম সময় লাগে।
একটি নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন হয়।
পুরো প্রক্রিয়া জুড়ে সিস্টেম এবং পরিবেশের মধ্যে সাম্যাবস্থা বজায় থাকে।
প্রাথমিক ও চূড়ান্ত অবস্থায় সাম্যাবস্থা অর্জিত হতে পারে, কিন্তু মধ্যবর্তী সময়ে নাও থাকতে পারে।
স্থিতিস্থাপক বস্তুর ধীরে ধীরে প্রসারণ বা সংকোচন, বরফ ধীরে ধীরে গলে পানি হওয়া ও পানি ধীরে ধীরে জমে বরফ হওয়া
তাপের প্রবাহ, ঘর্ষণ, রাসায়নিক বিক্রিয়া, গ্যাসের মুক্ত প্রসারণ, রোধের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ।
যে ইঞ্জিনে জ্বালানি ইঞ্জিনের অভ্যন্তরে একটি আবদ্ধ প্রকোষ্ঠে দহন করা হয় এবং সেই দহনের ফলে উৎপন্ন গ্যাস সরাসরি পিস্টনের উপর চাপ সৃষ্টি করে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে, তাকে অন্তর্দহন ইঞ্জিন বলে।বৈশিষ্ট্য:
জ্বালানি ইঞ্জিনের ভেতরেই পোড়ানো হয়।
ছোট এবং হালকা
সাধারণত অটোমোবাইল, মোটরসাইকেল, বিমান, জেনারেটর ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়।
যে ইঞ্জিনে জ্বালানি ইঞ্জিনের বাইরে একটি আলাদা স্থানে দহন করা হয় এবং সেই দহনের ফলে উৎপন্ন তাপ কোনো কার্যরত তরল (যেমন জল) বা গ্যাসের মাধ্যমে ইঞ্জিনের ভেতরে সরবরাহ করা হয়, যা পরবর্তীতে পিস্টন বা টারবাইনকে ঘুরিয়ে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে, তাকে বহির্দহন ইঞ্জিন বলে।সহজভাষায়,যে ইঞ্জিনে জ্বালানির দহন ইঞ্জিনের বাইরে ঘটে এবং সৃষ্ট তাপ ইঞ্জিনে প্রবাহিত হয়ে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপ নেয়, তাকে বহির্দহন ইঞ্জিন বলে।বৈশিষ্ট্য:
জ্বালানি ইঞ্জিনের বাইরে পোড়ানো হয়।
আকারে বড়
সাধারণত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বা পুরাতন ধরনের রেল ইঞ্জিনে ব্যবহৃত হতো।
উদাহরণ: স্টিম ইঞ্জিন (বা বাষ্পীয় ইঞ্জিন)।
তাপ ইঞ্জিন (Heat Engine):
যে যন্ত্র তাপশক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে, তাকে তাপ ইঞ্জিন বলে। এটি একটি তাপগতি চক্রের মাধ্যমে কাজ করে, যেখানে একটি কার্যরত পদার্থ (working substance) উচ্চ তাপমাত্রার উৎস থেকে তাপ গ্রহণ করে, সেই তাপের কিছু অংশকে যান্ত্রিক কাজে রূপান্তরিত করে এবং অবশিষ্ট তাপ নিম্ন তাপমাত্রার তাপগ্রাহকে বর্জন করে।
বৈশিষ্ট্য:
তাপশক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে।
কার্যরত পদার্থের তাপমাত্রার পার্থক্য এর কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য।
বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন অন্তর্দহন ইঞ্জিন ও বহির্দহন ইঞ্জিন উভয়ই তাপ ইঞ্জিনের অন্তর্ভুক্ত।
তাপ ইঞ্জিন যে পরিমাণ তাপশক্তি গ্রহণ করে তার কত শতাংশ যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে, সেই অনুপাতকে ইঞ্জিনের তাপীয় দক্ষতা (Thermal Efficiency) বলে। অন্যভাবে বলা যায়, ইঞ্জিন কর্তৃক উৎপাদিত কার্যকর কাজ এবং ইঞ্জিনে সরবরাহকৃত মোট তাপশক্তির অনুপাতই হলো তাপীয় দক্ষতা।গাণিতিকভাবে, তাপীয় দক্ষতাকে (η) নিম্নলিখিতভাবে প্রকাশ করা হয়:
এন্ট্রপি কি? দেখাও যে, পৃথিবীর এন্ট্রপি ধনাত্মক।
এন্ট্রপি হলো একটি তাপগতিগত রাশি যা কোনো সিস্টেমের বিশৃঙ্খলা বা অণুগুলোর এলোমেলো অবস্থার পরিমাপ করে। সহজভাবে বললে, এন্ট্রপি যত বেশি, সিস্টেমের অণুগুলো তত বেশি বিশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত থাকে এবং সেই সিস্টেম থেকে কার্যকর কাজ পাওয়া তত কঠিন হয়ে পড়ে।
অর্থাৎ এন্ট্রপি dS =dQ / dTএটি একটি ধনাত্মক রাশি। অতএব পৃথিবীর এন্ট্রপি ধনাত্মক
কার্নো চক্র মূলনীতিসহ আলোচনা করো।
কার্নো চক্র (Carnot Cycle) একটি আদর্শ তাপগতীয় চক্র যা ১৮২৪ সালে ফরাসি প্রকৌশলী সাদি কার্নো প্রস্তাব করেন। এটি একটি প্রত্যাবর্তী (reversible) চক্র এবং দুটি সমোষ্ণ (isothermal) ও দুটি রুদ্ধতাপীয় (adiabatic) প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে গঠিত। কার্নো চক্রের মূলনীতি হলো দুটি তাপাধারের (heat reservoir) মধ্যে কার্যনির্বাহী পদার্থের (working substance) প্রত্যাবর্তী পরিবর্তনের মাধ্যমে সর্বাধিক পরিমাণ কার্য (work) পাওয়া।
কার্নো চক্রের মূলনীতি (Principle of the Carnot Cycle)
কার্নো চক্র একটি আদর্শ প্রত্যাবর্তী তাপগতীয় চক্র, যেখানে কার্যনির্বাহী বস্তু (যেমন আদর্শ গ্যাস) প্রত্যাগামী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট চাপ, আয়তন ও তাপমাত্রা থেকে যাত্রা করে। এটি দুটি সমোষ্ণ (isothermal) প্রসারণ ও সংকোচন এবং দুটি রুদ্ধতাপীয় (adiabatic) প্রসারণ ও সংকোচনের মধ্য দিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় গৃহীত তাপের কিছু অংশ কার্যে রূপান্তরিত হয় এবং অবশিষ্ট তাপ নিম্ন তাপমাত্রার তাপাধারে বর্জিত হয়, এরপর কার্যনির্বাহী বস্তু পুনরায় তার আদি অবস্থায় ফিরে আসে।
ইঞ্জিনের বর্ণনা (Description of the Engine)
কার্নো ইঞ্জিনের মূলত চারটি অংশ থাকে:
চোঙ বা সিলিন্ডার (Cylinder) (A): এর তিন দিকের দেয়াল তাপ অন্তরক এবং তলদেশ তাপ পরিবাহী। এর অভ্যন্তরে ঘর্ষণবিহীনভাবে চলাচল করতে পারে এমন একটি তাপ অন্তরক পিস্টন (P) থাকে এবং কার্যকরী পদার্থ (আদর্শ গ্যাস) আবদ্ধ থাকে।
তাপ আধার বা তাপ উৎস (Heat source) (M): T1 পরম তাপমাত্রায় অবস্থিত একটি উচ্চ তাপগ্রাহিতাযুক্ত উত্তপ্ত বস্তু, যা তাপ সরবরাহ করে এবং যার তাপমাত্রা স্থির থাকে।
তাপ গামলা বা তাপ গ্রাহক (Heat sink) (N): T2 (T2<<T1) পরম তাপমাত্রায় অবস্থিত একটি অনুরূপ শীতল বস্তু, যা তাপ গ্রহণ করে এবং যার তাপমাত্রাও স্থির থাকে।
আসন (S): একটি সম্পূর্ণ তাপ নিরোধক পাটাতন, যার উপর চোঙটিকে বসানো যায়।
কার্নো চক্র একটি প্রত্যাগামী চক্র (Carnot Cycle is a Reversible Process)
কার্নো চক্রকে একটি প্রত্যাগামী প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করার কারণ হলো এর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ:
পিস্টন ও সিলিন্ডারের মধ্যে কোনো ঘর্ষণ অনুপস্থিত।
কার্যকরী পদার্থের উপর প্রযুক্ত প্রক্রিয়াগুলো অত্যন্ত ধীরে ধীরে সম্পন্ন হয় (quasi-static)।
সিলিন্ডার নির্মাণে আদর্শ তাপ নিরোধক ও পরিবাহী ব্যবহার করা হয়।
তাপ উৎস ও তাপ গ্রাহকের তাপগ্রাহিতা অসীম হওয়ায় সমোষ্ণ প্রক্রিয়াগুলো স্থির তাপমাত্রায় ঘটে।
কার্নো চক্রের পর্যায় (Steps of the Carnot Cycle)
প্রথম ধাপ (A → B): সমোষ্ণ প্রসারণ (Isothermal Expansion):
সিলিন্ডারকে তাপ উৎসের (T1) উপর স্থাপন করা হয়।
গ্যাস Q1 পরিমাণ তাপ শোষণ করে ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়।
তাপমাত্রা স্থির থাকে (T1), চাপ P1 থেকে P2 এবং আয়তন V1 থেকে V2 হয়।
দ্বিতীয় ধাপ (B → C): রুদ্ধতাপীয় প্রসারণ (Adiabatic Expansion):
সিলিন্ডারকে তাপ নিরোধক আসনের উপর স্থাপন করা হয়।
গ্যাস প্রসারিত হতে থাকে এবং তাপমাত্রা T1 থেকে T2 এ নেমে আসে।
কোনো তাপের আদান-প্রদান হয় না (Q=0), চাপ P2 থেকে P3 এবং আয়তন V2 থেকে V3 হয়।
তৃতীয় ধাপ (C → D): সমোষ্ণ সংকোচন (Isothermal Compression):
সিলিন্ডারকে তাপ গ্রাহকের (T2) উপর স্থাপন করা হয়।
গ্যাসের উপর পিস্টন দ্বারা কাজ করা হয় এবং গ্যাস Q2 পরিমাণ তাপ বর্জন করে সংকুচিত হয়।
তাপমাত্রা স্থির থাকে (T2), চাপ P3 থেকে P4 এবং আয়তন V3 থেকে V4 হয়।
চতুর্থ ধাপ (D → A): রুদ্ধতাপীয় সংকোচন (Adiabatic Compression):
সিলিন্ডারকে তাপ নিরোধক আসনের উপর স্থাপন করা হয়।
গ্যাসের উপর কাজ করা হয় এবং তাপমাত্রা T2 থেকে T1 এ বৃদ্ধি পায়, যতক্ষণ না গ্যাস তার আদি অবস্থায় ফিরে আসে।
কোনো তাপের আদান-প্রদান হয় না (Q=0), চাপ P4 থেকে P1 এবং আয়তন V4 থেকে V1 হয়।
সমান (চিহ্ন ঋণাত্মক হবে কারণ গ্যাসের উপর কাজ করা হয়েছে)।
মোট কৃত কাজ, W =W1 + W2−W3 − W4, যা P-V চিত্রের ABCD আবদ্ধ ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের সমান।
এই চারটি ধাপের মাধ্যমে কার্নো চক্র সম্পন্ন হয়, যেখানে তাপশক্তির কিছু অংশ যান্ত্রিক কার্যে রূপান্তরিত হয়।