পদার্থের অবস্থা কী? – ৯-১০ শ্রেণির সহজ রসায়ন ব্যাখ্যা
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে—পানি, বাতাস, পাথর কিংবা আগুন—সবই পদার্থের কোনো না কোনো অবস্থায় রয়েছে। পদার্থ সাধারণত তিনটি প্রধান অবস্থায় পাওয়া যায়: কঠিন, তরল ও গ্যাস। তবে আধুনিক বিজ্ঞানে আরও কিছু অবস্থা শনাক্ত হয়েছে, যেমন প্লাজমা ও বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন। চলুন, প্রতিটি অবস্থা সম্পর্কে সহজভাবে জেনে নিই।

১. কঠিন (Solid)
কঠিন পদার্থে কণাগুলো খুব কাছাকাছি ও শক্তভাবে বাধা থাকে। এদের একটি নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন থাকে। যেমন: বরফ, পাথর, কাঠ।
বৈশিষ্ট্য:
- নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন আছে
- কঠিন ও দৃঢ়
- কণাগুলো একে অপরের খুব কাছে থাকে
২. তরল (Liquid)
তরল পদার্থের কণাগুলো কঠিনের তুলনায় কিছুটা দূরে থাকে। এদের নির্দিষ্ট আয়তন থাকলেও নির্দিষ্ট আকার থাকে না। এটি পাত্রের আকার অনুযায়ী রূপ নেয়। যেমন: পানি, দুধ, তেল।
বৈশিষ্ট্য:
- নির্দিষ্ট আয়তন আছে, কিন্তু নির্দিষ্ট আকার নেই
- পাত্রের আকার ধারন করে
- কণাগুলো সরে যেতে পারে
৩. গ্যাস (Gas)
গ্যাসের কণাগুলো একে অপরের থেকে অনেক দূরে থাকে। তাই গ্যাসের না নির্দিষ্ট আকার থাকে, না নির্দিষ্ট আয়তন। যেমন: বায়ু, অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড।
বৈশিষ্ট্য:
- নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন নেই
- কণাগুলো দ্রুত গতিতে চলাফেরা করে
- গ্যাস সহজেই সংকুচিত বা সম্প্রসারিত হতে পারে

৪. প্লাজমা (Plasma)
প্লাজমা হলো এমন এক অবস্থা, যেখানে গ্যাসীয় কণাগুলো এত বেশি শক্তি পায় যে তারা আয়নিত হয়, অর্থাৎ ইলেকট্রন ও আয়নে বিভক্ত হয়ে যায়। এটি সৌরজগতের তারাগুলোর মধ্যে সাধারণত দেখা যায়। যেমন: সূর্য, বজ্রপাত।
বৈশিষ্ট্য:
- উচ্চ তাপমাত্রায় তৈরি হয়
- আয়ন ও ইলেকট্রনের সমাহার
- বিদ্যুৎ পরিবাহী
৫. বস-আইনস্টাইন ঘনীভবন (Bose-Einstein Condensate)
এটি পদার্থের একটি বিশেষ অবস্থা যা অতি নিম্ন তাপমাত্রায় তৈরি হয়। এই অবস্থায় কণাগুলো এত ধীরে চলে যে তারা একসাথে একই কোয়ান্টাম অবস্থায় চলে যায়, ফলে তারা একরকম “একটি কণা”র মতো আচরণ করে।
বৈশিষ্ট্য:
- অতিপ্রশান্ত ও নিম্ন তাপমাত্রায় পাওয়া যায়
- কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে
- গবেষণাগারে তৈরি হয়
কণার গতিতত্ত্ব:
পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে পদার্থের আচরণ বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো কণার গতিতত্ত্ব (Kinetic Theory of Matter)। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে, সব পদার্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমষ্টি, এবং এই কণাগুলো সবসময় গতিশীল থাকে। পদার্থের অবস্থান পরিবর্তন, তাপীয় সম্প্রসারণ, গলন ও বাষ্পীকরণ ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলোর পেছনে কণাগুলোর গতি ও পারস্পরিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কণার গতিতত্ত্বের মূল ধারণা
কণার গতিতত্ত্বে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা রয়েছে:
- পদার্থ কণা দ্বারা গঠিত: সব ধরনের পদার্থ অসংখ্য ছোট ছোট কণার (অণু বা পরমাণু) সমন্বয়ে গঠিত।
- কণাগুলো সবসময় গতিশীল: কণাগুলো স্থির থাকে না, তারা সারাক্ষণ কমবেশি গতিতে চলতে থাকে—যা তাদের শক্তির উপর নির্ভর করে।
- তাপমাত্রা ও কণার গতি: কণার গতি তাপমাত্রার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। তাপমাত্রা বাড়ালে কণাগুলো দ্রুত গতিতে চলে, তাপমাত্রা কমলে ধীরে চলে।
- কণার মধ্যে ফাঁক থাকে: পদার্থের অবস্থার উপর নির্ভর করে কণাগুলোর মধ্যে দূরত্ব পরিবর্তিত হয়।
- কণার মধ্যে আকর্ষণ শক্তি থাকে: কণাগুলো একে অপরকে আকর্ষণ করে, এবং এই আকর্ষণ শক্তির পরিমাণ অবস্থার উপর নির্ভর করে।
পদার্থের বিভিন্ন অবস্থায় কণার গতি ও বিন্যাস

১. কঠিন (Solid) পদার্থ :
- কণাগুলো ঘনভাবে গুচ্ছাকারে বিন্যস্ত থাকে।
- তারা একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে কেবল কম্পন করে।
- আকর্ষণ শক্তি বেশি এবং গতি কম।
- ঘন পদার্থের নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন থাকে।
২. তরল (Liquid) পদার্থ :
- কণাগুলো কিছুটা দূরে থাকে এবং একে অপরের উপর দিয়ে সরে যেতে পারে।
- তারা একত্রে থাকে কিন্তু অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে।
- আকর্ষণ শক্তি মাঝারি, গতি মাঝারি।
- তরল পদার্থের নির্দিষ্ট আয়তন থাকে কিন্তু আকার পাত্র অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।
৩. গ্যাস (Gas)পদার্থ :
- কণাগুলোর মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশি।
- তারা স্বাধীনভাবে এবং উচ্চ গতিতে চলাফেরা করে।
- আকর্ষণ শক্তি খুব কম, কিন্তু গতি বেশি।
- গ্যাসের নির্দিষ্ট আকার বা আয়তন থাকে না। এটি পাত্রের আকার নেয় এবং সহজে সংকুচিত বা সম্প্রসারিত হতে পারে।
কণার গতিতত্ত্ব থেকে পাওয়া ব্যাখ্যা
এই তত্ত্ব ব্যবহার করে আমরা অনেক বাস্তব ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারি, যেমন:
- বাষ্পীকরণ: তরল কণাগুলো বেশি শক্তি পেলে তারা পৃষ্ঠ থেকে পালিয়ে যায় এবং গ্যাসে পরিণত হয়।
- বিকাশ বা সম্প্রসারণ: তাপ দিলে কণাগুলোর গতি বেড়ে যায়, ফলে তারা একে অপর থেকে দূরে সরে গিয়ে বস্তু সম্প্রসারিত করে।
- চাপ (Pressure): গ্যাসীয় কণাগুলো যখন পাত্রের দেয়ালে আঘাত করে, তখন চাপ সৃষ্টি হয়। কণার গতি যত বেশি, চাপ তত বেশি।
গাণিতিক দৃষ্টিকোণ
কণার গতিতত্ত্বের একটি গাণিতিক রূপ আছে যা গ্যাসের চাপ, আয়তন ও তাপমাত্রার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে। এটি আদর্শ গ্যাস তত্ত্বের ভিত্তি রচনা করে।
উদাহরণস্বরূপ: আদর্শ গ্যাসের ক্ষেত্রে কণাগুলোর গড় গতি শক্তি
KE=3/2 kT
এখানে,
- KE হলো কণার গড় গতিশক্তি,
- k হলো বল্টজমান ধ্রুবক,
- T হলো কেলভিন তাপমাত্রা।
এই সূত্রটি প্রমাণ করে যে তাপমাত্রা বাড়লে কণাগুলোর গতিশক্তি বাড়ে।
ব্যাপন কী?
কোনো মাধ্যমে কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় বস্তুর স্বতঃস্ফূর্ত ও সমভাবে পরিব্যাপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাপন বলে। যেমন- একটি পাকা কাঁঠাল ঘরের একটি কোণে রেখে দিলে তার গন্ধ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এটিই হলো ব্যাপন। কোনো পদার্থের ব্যাপন হার পদার্থের ভর ও ঘনত্বের উপর নির্ভরশীল।
সরলভাবে: যেখানে কণার সংখ্যা বেশি, সেখান থেকে তারা কম ঘন এলাকার দিকে চলে যায়, যতক্ষণ না তারা সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্যাপনের বৈশিষ্ট্য
- স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া: এটি কোনো বাহ্যিক শক্তি ছাড়া নিজে থেকেই ঘটে।
- ঘনত্বের পার্থক্য প্রভাব ফেলে: যত বেশি পার্থক্য, ব্যাপন তত দ্রুত হয়।
- তাপমাত্রা প্রভাব ফেলে: তাপমাত্রা বেশি হলে কণাগুলোর গতি বাড়ে, ফলে ব্যাপন দ্রুত ঘটে।
- মাধ্যমের ধরন গুরুত্বপূর্ণ: গ্যাসে ব্যাপন সবচেয়ে দ্রুত হয়, তরলে মাঝারি, আর ঘনে সবচেয়ে ধীরে।
ব্যাপনের উদাহরণ
১. গ্যাসে ব্যাপন:
- ঘরে সুগন্ধি স্প্রে করলে তা কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
- কারণ: গ্যাসীয় কণাগুলো দ্রুত গতিতে চলাফেরা করে এবং ফাঁকা জায়গা বেশি থাকে।
২. তরলে ব্যাপন:
- গরম পানিতে চা পাতার রং ও গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
- এতে চা পাতার দ্রবণীয় পদার্থ পানিতে মিশে যায়।
৩. জীববিজ্ঞানে ব্যাপন:
- কোষের ঝিল্লি দিয়ে অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইডের যাতায়াত ব্যাপনের মাধ্যমেই হয়।
- উদ্ভিদের পাতায় স্টোমাটা দিয়ে গ্যাসের বিনিময় ঘটে ব্যাপনের মাধ্যমে।
ব্যাপন বনাম সঞ্চালন (Diffusion vs. Convection)
- ব্যাপন: কণার স্বতঃস্ফূর্ত নড়াচড়া; বাহ্যিক প্রভাব ছাড়াই ঘটে।
- সঞ্চালন: বাহ্যিক শক্তি বা চাপের মাধ্যমে কণার স্থানান্তর। যেমন: বাতাসে গরম ও ঠান্ডা বায়ুর চলাচল।

এই সূত্র বলছে, ঘনত্ব যত বেশি পরিবর্তিত হবে, ব্যাপন তত বেশি হবে।
ব্যাপনের গুরুত্ব
- শরীরের কোষে গ্যাস ও পুষ্টির পরিবহন।
- শিল্পে গ্যাসের মিশ্রণ ও পৃথকীকরণ।
- ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে ওষুধ তৈরি ও কার্যকারিতা বোঝার জন্য।
- পরিবেশ বিজ্ঞানে দূষণের বিস্তার বিশ্লেষণে।
নিঃসরণ কী?
বাহ্যিক চাপের প্রভাবে সরু ছিদ্র পথে কোনো গ্যাসের সজোরে বের হয়ে আসার প্রক্রিয়াকে নিঃসরণ বলে। যেমন- উচ্চ চাপে রক্ষিত কোনো গ্যাস সিলিন্ডারে একটি সূক্ষ্ম ছিদ্র করলে গ্যাস সজোরে বের হয়ে আসবে। এই প্রক্রিয়াটি একটি নিঃসরণ প্রক্রিয়া।
সহজ কথায়, সরু ছিদ্রপথে কোনো গ্যাসের অনুসমূহের উচ্চচাপীয় অঞ্চল থেকে নিন্মচাপীয় অঞ্চলে সজোরে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে নি:সরণ বলে।
নিঃসরণের বাস্তব উদাহরণ
১. কোষে পানির চলাচল:
- কোষের ভিতরে ও বাইরে পানির পরিমাণ ও দ্রবণের ঘনত্বের ভিত্তিতে পানি প্রবেশ বা নির্গমন করে।
- কোষ যদি উচ্চ ঘনত্বের পরিবেশে পড়ে, তখন পানি বের হয়ে কোষ শুকিয়ে যেতে পারে।
২. উদ্ভিদের শিকড়:
- শিকড়ের কোষ মাটির দ্রবণের তুলনায় বেশি ঘন, তাই পানি মাটি থেকে শিকড়ে প্রবেশ করে।
৩. মাছের পরিবেশ:
- লবণ পানির মাছকে মিঠা পানিতে রাখলে কোষে পানি বেশি ঢুকে ফেটে যেতে পারে—এটি নিঃসরণের কারণে হয়।
নিঃসরণের গুরুত্ব
- জৈবিক ভারসাম্য: কোষের আকার, চাপ ও পানি ভারসাম্য রক্ষায় নিঃসরণ অপরিহার্য।
- রক্তে পানি ও লবণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে: রক্তে সঠিক ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- চিকিৎসাবিজ্ঞানে: ইনট্রাভেনাস (IV) সল্যুশন নির্বাচন করার সময় নিঃসরণের নীতিগুলো বিবেচনা করা হয়।
ব্যাপন ও নিঃসরণ এর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য:
ক্রমিক নং | ব্যাপন | নিঃসরণ |
১. | কোনো মাধ্যমে কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় বস্তুর স্বতঃস্ফূর্ত ও সমভাবে পরিব্যাপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাপন বলে | সরু ছিদ্রপথে কোনো গ্যাসের অনুসমূহের উচ্চচাপীয় অঞ্চল থেকে নিন্মচাপীয় অঞ্চলে সজোরে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে নি:সরণ বলে |
২. | ইহা একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া | ইহা স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া নয় |
৩. | ব্যাপনের ক্ষেত্রে চাপের প্রভাব নেই | নিঃসরণের ক্ষেত্রে চাপের প্রভাব আছে |
৪. | ব্যাপনের ক্ষেত্রে কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ উপযুক্ত মাধ্যমের সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে | নিঃসরণের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র গ্যাসীয় পদার্থ গ্যাসীয় মাধ্যমে সরু ছিদ্র পথে সজোরে বেরিয়ে আসে |
৫. | ইহা দীর্ঘ সময় স্হায়ী হয় | ইহা সল্প সময় স্হায়ী হয় |
৬. | ইহা একটি ধীর প্রক্রিয়া | ইহা একটি দ্রুত প্রক্রিয়া |
৭. | ইহা উচ্চ ঘনত্ব থেকে নিন্ম ঘনত্বের দিকে প্রবাহিত হয় | ইহা উচ্চ চাপ থেকে নিন্ম চাপের দিকে প্রবাহিত হয় |
৮. | ব্যাপনের বেলায় পাত্রের ভিতরে ও বাইরে একই বায়ুর চাপ থাকে | নিঃসরণের বেলায় পাত্রের ভিতরে অধিক চাপ এবং বাইরে কম চাপ বা ভেকুয়াম অবস্থা থাকে |
মোমবাতির দহন ও পদার্থের তিন অবস্থা

মোমবাতির উপাদান
- মোমবাতি তৈরি হয় প্যারাফিন নামক একটি জৈব যৌগ দিয়ে, যা মূলত এক ধরনের ঘন পদার্থ।
- এর মধ্যে একটি সুতার সলতে থাকে, যা দহন প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহায্য করে।
মোমবাতি জ্বলার ধাপসমূহ
১. তাপ প্রয়োগ ও গলন (Solid → Liquid)
- যখন আগুন সলতিতে দেওয়া হয়, তখন তা উত্তপ্ত হয় এবং মোমের আশেপাশের অংশ গলতে শুরু করে।
- গলিত মোম সলতির মধ্য দিয়ে উপরে উঠে আসে।
- এখানে প্যারাফিন ঘন অবস্থা থেকে তরলে রূপ নেয়।
২. বাষ্পায়ন (Liquid → Gas)
- সলতির আগুনে গলিত মোম আরও উত্তপ্ত হয়ে বাষ্পে পরিণত হয়।
- এই বাষ্পীয় মোম হল জ্বালানি, যা আগুনে দহন হয়।
- অর্থাৎ, মোম এবার তরল থেকে গ্যাসীয় অবস্থায় গেল।
৩. দহন (Combustion: রাসায়নিক বিক্রিয়া)
- মোমের বাষ্প যখন বাতাসের অক্সিজেন এর সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তখন তাপ ও আলো উৎপন্ন হয়।
- এটি একটি বহির্গামী (Exothermic) রাসায়নিক বিক্রিয়া: CnH2n+2+O2 → CO2+ H2O + তাপ + আলো
মোমবাতির শিখা
মোমবাতির শিখার বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া ঘটে:
- অন্ধকার কেন্দ্র: বাষ্প তৈরি হচ্ছে
- উজ্জ্বল হলুদ অংশ: অসম্পূর্ণ দহন
- নীলাভ প্রান্ত: সম্পূর্ণ দহন, সবচেয়ে গরম অংশ
গলন ও স্ফুটন:
১. গলন (Melting)
সংজ্ঞা:
গলন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো কঠিন পদার্থ নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে তরলে পরিণত হয়।
বিস্তারিত ব্যাখ্যা:
কঠিন পদার্থে কণাগুলো খুব ঘনভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে একে অপরের সঙ্গে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু তাপ প্রয়োগে তাদের কম্পনের গতি বৃদ্ধি পায়। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এসে কণাগুলো এতটাই শক্তি পায় যে, তারা একে অপরের ওপর থেকে আলগা হয়ে যায় এবং অবাধে গতি করতে পারে—ফলে সেই পদার্থ তরলে পরিণত হয়।
এই নির্দিষ্ট তাপমাত্রাকে বলে গলনাঙ্ক (Melting Point)। প্রতিটি পদার্থের গলনাঙ্ক আলাদা। যেমন:
- বরফের গলনাঙ্ক: ০°C
- লোহার গলনাঙ্ক: প্রায় ১৫৩৮°C
- সোনার গলনাঙ্ক: ১০৬৪°C
উদাহরণ:
- রান্নার সময় ঘি বা মাখন গলে তরলে পরিণত হয়।
- গ্রীষ্মকালে রোদে রাখা মোমবাতি গলে যায়।
- ধাতু গলিয়ে বিভিন্ন আকৃতি তৈরি করা হয় (ঢালাই/কাস্টিং)।
২. স্ফুটন (Boiling)
সংজ্ঞা:
স্ফুটন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো তরল নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে গ্যাসীয় অবস্থায় পরিণত হয় এবং সারা তরল জুড়ে বুদবুদের আকারে বাষ্প তৈরি হয়।
বিস্তারিত ব্যাখ্যা:
তরল পদার্থে কণাগুলো একে অপরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ঢিলেঢালা অবস্থায় থাকে, তবে একধরনের আন্তঃআকর্ষণ বল তাদের একত্রে রাখে। তাপ প্রয়োগে কণাগুলোর গতি বাড়ে। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কণাগুলো এত শক্তি পায় যে তারা আন্তঃআকর্ষণ বল ভেঙে বের হয়ে যায় এবং গ্যাসীয় অবস্থায় রূপ নেয়।
এই নির্দিষ্ট তাপমাত্রাকে বলে স্ফুটনাঙ্ক (Boiling Point)। উদাহরণ:
- পানির স্ফুটনাঙ্ক: ১০০°C
- অ্যালকোহলের স্ফুটনাঙ্ক: প্রায় ৭৮°C
- পারদের স্ফুটনাঙ্ক: ৩৫৭°C
উল্লেখযোগ্য বিষয়:
স্ফুটন একমাত্র প্রক্রিয়া, যেখানে তরলের ভিতরের কণারাও বাষ্পে পরিণত হয় (তুলনামূলকভাবে বাষ্পায়নে শুধুমাত্র পৃষ্ঠের কণা)। তাই স্ফুটনের সময় দেখা যায়—সারা তরলজুড়ে বুদবুদ তৈরি হচ্ছে।
উদাহরণ:
- পানি ফুটে বাষ্প হয়ে যায়।
- চাল বা ডিম সিদ্ধ করার সময় পানি ফুটে ওঠে।
- ফ্যাক্টরিতে কেমিক্যাল সেপারেশন করতে স্ফুটন ব্যবহার করা হয়।
বিভিন্ন পদার্থের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক
পদার্থ | গলনাঙ্ক | স্ফুটনাঙ্ক |
সীসা | ৩২৭°C | ১৭৪০°C |
লোহা | ১৫৩৮°C | ২৮৬২°C |
রুপা | ৯৬১.৮°C | ২১৬২°C |
তামা | ১০৮৫°C | ২৫৬২°C |
দস্তা | ৪২০°C | ৯০৭°C |
টিন | ২৩১.৯°C | ২৬০২°C |
হীরা | ৩৫৫০°C | ৪৮৩০°C |
সোনা | ১০৬৪°C | ২৭০০°C |
ম্যানেসিয়াম | ৬৫০°C | ১০৯১°C |
পটাসিয়াম | ৬৩.৫°C | ৭৬০°C |
অ্যালুমিনিয়াম | ৬৬০.৩°C | ২৪৭০°C |
প্ল্যাটিনাম | ১৭৬৮°C | ৩৮২৫°C |
সিলিকন | ১৪১০°C | ৩২৬৫°C |
ক্যাডমিয়াম | ৩২১.১°C | ৭৬৬.৮°C |
গ্রাফাইট | ৩৬৭৫°C | ৪০২৭°C |
আয়োডিন | ১১৩.৭°C | ১৮৪.৩°C |
ম্যাঙ্গানিজ | ১২৪৬°C | ২০৬১°C |
নিকেল | ১৪৫৫°C | ২৭৩০°C |
ফসফরাস | ৪৪.১°C | ২৮০.৫°C |
সোডিয়াম | ৯৭.৭৯°C | ৮৮২.৯°C |
সালফার | ১১২.৮°C | ৪৪৪.৬°C |
লিথিয়াম | ১৮০.৫°C | ১৩৪২°C |
কোবাল্ট | ১৪৯৫°C | ২৮৭০°C |
হাইড্রোজেন | -২৫৯.২°C | -২৫২.৯°C |
অক্সিজেন | -২১৮.৮°C | -১৮৩°C |
নাইট্রোজেন | -২১০°C | -১৯৫.৮°C |
হিলিয়াম | -২৭২.২°C | -২৬৮.৯°C |
ক্লোরিন | -১০১.৫°C | -৩৪.০৪°C |
ব্রোমিন | -৭.২°C | ৫৮.৮°C |
পারদ | -৩৮.৯°C | ৩৫৬.৭°C |
পাতন ও উর্ধ্বপাতন:

১. পাতন (Distillation)
সংজ্ঞা:
পাতন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে এক বা একাধিক তরল পদার্থের মিশ্রণকে উত্তপ্ত করে বাষ্পে পরিণত করা হয় এবং তারপর সেই বাষ্পকে ঠান্ডা করে আবার তরলে পরিণত করে পৃথক করা হয়।
মূলনীতি:
প্রত্যেক তরল পদার্থের স্ফুটনাঙ্ক (boiling point) ভিন্ন। যে পদার্থের স্ফুটনাঙ্ক কম, তা আগে বাষ্পে পরিণত হয় এবং সহজে আলাদা করা যায়।
প্রক্রিয়া:
- মিশ্রণ উত্তপ্ত করা হয়।
- স্ফুটনাঙ্ক কম এমন তরল বাষ্প হয়ে উঠে যায়।
- বাষ্পকে ঠান্ডা করে কনডেনসারে তরলে পরিণত করা হয়।
- সংগ্রাহকে বিশুদ্ধ তরল পাওয়া যায়।
ধরন:
- সরল পাতন (Simple Distillation): দুটি ভিন্ন স্ফুটনাঙ্কযুক্ত তরল আলাদা করতে।
- ভগ্নাংশ পাতন (Fractional Distillation): বহু উপাদানের জটিল মিশ্রণ আলাদা করতে।
ব্যবহার:
- খনিজ তেল থেকে বিভিন্ন জ্বালানি (পেট্রোল, ডিজেল) আলাদা করা।
- মদ্য প্রস্তুতিতে অ্যালকোহল পৃথক করা।
- সমুদ্রের নোনা পানি বিশুদ্ধ করার জন্য।

২. উর্ধ্বপাতন (Sublimation)
সংজ্ঞা:
উর্ধ্বপাতন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে একটি কঠিন পদার্থ সরাসরি গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয়, তরল অবস্থায় না গিয়ে।
মূলনীতি:
সব পদার্থ উর্ধ্বপাতন করে না। কেবল কিছু নির্দিষ্ট পদার্থ, যাদের গলনাঙ্ক এবং স্ফুটনাঙ্ক খুব কাছাকাছি, তারাই উত্তপ্ত হলে সরাসরি গ্যাসে রূপ নেয়।
উদাহরণস্বরূপ উর্ধ্বপাতিত পদার্থ:
- অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড (NH₄Cl)
- আয়োডিন (I₂)
- নেফথালিন বল
- ক্যাফোর (কাপূর)
প্রক্রিয়া:
- মিশ্রণ উত্তপ্ত করা হয়।
- উর্ধ্বপাতনযোগ্য পদার্থ গ্যাসে পরিণত হয়।
- ঠান্ডা হলে সেই গ্যাস আবার কঠিন রূপে জমে যায়।
ব্যবহার:
- অপদ্রব্য থেকে উর্ধ্বপাতনযোগ্য পদার্থ আলাদা করা।
- ঘরে কাপড়ের সঙ্গে নেফথালিন দিয়ে পোকার আক্রমণ ঠেকানো।
- কিছু রাসায়নিক বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায়।