ভৌত আলোকবিজ্ঞান পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা যা আলোর প্রকৃতি এবং এর বিভিন্ন ঘটনা যেমন প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যাতিচার, অপবর্তন, সমাবর্তন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। এই অধ্যায়ে আমরা আলোর তরঙ্গ ধর্ম এবং এর সাথে সম্পর্কিত কিছু মৌলিক ধারণা সম্পর্কে জানবো।

তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ কাকে বলে? ব্যাখ্যা কর।

তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ কাকে বলে? ব্যাখ্যা কর।

তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ (Electromagnetic Wave): যে তরঙ্গ সঞ্চালনের জন্য কোনো জড় মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না এবং যা দোদুল্যমান তড়িৎ ক্ষেত্র (Electric Field) ও চৌম্বক ক্ষেত্র (Magnetic Field) এর সমন্বয়ে গঠিত, তাকে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ বলে। এই দুটি ক্ষেত্র পরস্পর এবং তরঙ্গের গতিপথের সাথে লম্বভাবে স্পন্দিত হয়।

ব্যাখ্যা:কল্পনা করুন, একটি দোদুল্যমান তড়িৎ আধান (যেমন, একটি ইলেকট্রন) তার চারপাশে তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি করে। যখন এই আধানটি স্পন্দিত হয়, তখন তার চারপাশে তড়িৎ ক্ষেত্রও পরিবর্তিত হয়। ম্যাক্সওয়েলের সূত্র অনুযায়ী, পরিবর্তিত তড়িৎ ক্ষেত্র তার আশেপাশে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। একইভাবে, পরিবর্তিত চৌম্বক ক্ষেত্র তার আশেপাশে একটি তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি করে। এই তড়িৎ ক্ষেত্র এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের পারস্পরিক আদান-প্রদান এবং দোলনের ফলে যে তরঙ্গ সামনের দিকে এগিয়ে চলে, সেটাই হলো তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ।

গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য:

  • এগুলো শূন্যস্থানেও (Vacuum) চলাচল করতে পারে।
  • এদের সঞ্চালনের জন্য মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না।
  • আলো নিজেই এক প্রকার তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ।
  • এগুলো আলোর বেগে (প্রায় 3×10∧8 m/s) সঞ্চালিত হয়।
  • বেতার তরঙ্গ, মাইক্রোওয়েভ, অবলোহিত রশ্মি, দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনী রশ্মি, এক্স-রে এবং গামা রশ্মি সবই তড়িৎচৌম্বক বর্ণালীর অংশ।

পয়েন্টিং ভেক্টর বলতে কী বুঝায়?

পয়েন্টিং ভেক্টর বলতে কী বুঝায়?

তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের সাথে শক্তি সঞ্চালিত হয়। এই শক্তি প্রবাহের দিক ও পরিমাণ বর্ণনা করার জন্য একটি ভেক্টর রাশি ব্যবহার করা হয়, যাকে পয়েন্টিং ভেক্টর (Poynting Vector) বলে।

সংজ্ঞা: কোনো তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের শক্তি প্রবাহের হার ও দিক নির্দেশক ভেক্টরকে পয়েন্টিং ভেক্টর বলে। এটি প্রতি একক ক্ষেত্রফলে প্রতি সেকেন্ডে সঞ্চালিত শক্তির পরিমাণ নির্দেশ করে।

ব্যাখ্যা:

পয়েন্টিং ভেক্টরকে সাধারণত S দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং এর মান তড়িৎ ক্ষেত্র E এবং চৌম্বক ক্ষেত্র B এর ক্রস গুণফলের সমানুপাতিক:

যেখানে, μ0​ হলো শূন্যস্থানের প্রবেশ্যতা (permeability of free space)।

পয়েন্টিং ভেক্টরের দিক তরঙ্গের গতিপথের দিকে নির্দেশ করে। এর একক হলো ওয়াট প্রতি বর্গমিটার (W/m²), যা শক্তি প্রবাহের ঘনত্বকে প্রকাশ করে। এটি দেখায় যে, একটি তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ প্রতি সেকেন্ডে প্রতি বর্গমিটারে কী পরিমাণ শক্তি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন, সূর্য থেকে পৃথিবীতে যে আলো আসে, তার শক্তি প্রবাহের হার পয়েন্টিং ভেক্টর দিয়ে পরিমাপ করা যায়।

 বেতার তরঙ্গ কী? ব্যাখ্যা কর।

বেতার তরঙ্গ কী? ব্যাখ্যা কর।

বেতার তরঙ্গ (Radio Wave) হলো এক প্রকার তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, যা তড়িৎচৌম্বক বর্ণালীর সর্বনিম্ন কম্পাঙ্ক (এবং দীর্ঘতম তরঙ্গদৈর্ঘ্য) অঞ্চলে অবস্থান করে।

ব্যাখ্যা:

বেতার তরঙ্গ কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়, যেমন রেডিও ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে। এই তরঙ্গগুলো দীর্ঘ দূরত্বে তথ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়, যা আমরা রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন এবং রাডারের মতো প্রযুক্তিগুলোতে ব্যবহার করি।

বেতার তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য:

  • কম্পাঙ্ক সাধারণত 3 কিলোহার্জ (kHz) থেকে 300 গিগাহার্জ (GHz) পর্যন্ত হয়ে থাকে।
  • এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশ দীর্ঘ হয়, যা কয়েক সেন্টিমিটার থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
  • এগুলো বিভিন্ন উপায়ে উৎপাদিত হতে পারে, যেমন দোদুল্যমান ইলেক্ট্রন প্রবাহ (oscillating electric current) দ্বারা।
  • বেতার তরঙ্গগুলি সহজেই ভবন এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পারে, যার কারণে এগুলি দূরবর্তী যোগাযোগের জন্য আদর্শ।
  • এগুলি বায়ুমণ্ডল দ্বারা খুব বেশি শোষিত হয় না, তাই দীর্ঘ-দূরত্বের যোগাযোগের জন্য উপযুক্ত।

হাইগেন্সের নীতি বিবৃত ও ব্যাখ্যা কর।

হাইগেন্সের নীতি বিবৃত ও ব্যাখ্যা কর।

হাইগেন্সের নীতি (Huygens’ Principle) আলোর তরঙ্গ ধর্মের একটি মৌলিক ব্যাখ্যা প্রদান করে এবং এটি আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, অপবর্তন এবং ব্যাতিচারের মতো ঘটনাগুলো বুঝতে সাহায্য করে।

বিবৃতি:

ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স ১৬৭৮ সালে এই নীতিটি বিবৃত করেন। এর দুটি প্রধান অংশ রয়েছে:

  1. প্রতিটি আলোক উৎসের (বা তরঙ্গমুখের) প্রতিটি বিন্দু একটি নতুন গৌণ তরঙ্গের উৎস হিসেবে কাজ করে, যা সব দিকে তরঙ্গিকা (wavelet) নির্গত করে।
  2. যেকোনো মুহূর্তে নতুন তরঙ্গমুখ হলো এই সমস্ত গৌণ তরঙ্গিকাগুলোকে স্পর্শ করে অঙ্কিত সম্মুখ খাম (forward envelope)।

ব্যাখ্যা:

সহজভাবে বলতে গেলে, হাইগেন্সের নীতি আলোর বিস্তারকে তরঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করে।

কল্পনা করুন, একটি আলোক উৎস থেকে আলো বেরিয়ে আসছে এবং একটি তরঙ্গমুখ (wavefront) তৈরি করছে। হাইগেন্সের নীতি অনুযায়ী, এই তরঙ্গমুখের প্রতিটি বিন্দুকে নতুন একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গের উৎস হিসেবে ধরা যায়। এই ক্ষুদ্র তরঙ্গগুলো (যাদেরকে তরঙ্গিকা বা secondary wavelets বলে) আবার সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই সব তরঙ্গিকাগুলোর অগ্রভাগকে স্পর্শ করে যে নতুন পৃষ্ঠ তৈরি হয়, সেটাই হলো পরবর্তী মুহূর্তে আলোর নতুন তরঙ্গমুখ।

উদাহরণ:

  • সরলরৈখিক সঞ্চালন: যদি একটি সমতল তরঙ্গমুখ থাকে, তবে এর প্রতিটি বিন্দু থেকে তরঙ্গিকা নির্গত হয়ে সামনের দিকে একটি নতুন সমতল তরঙ্গমুখ তৈরি করে। এটি প্রমাণ করে যে আলো সরলরেখায় চলে।
  • প্রতিফলন ও প্রতিসরণ: হাইগেন্সের নীতি ব্যবহার করে আলোর প্রতিফলন এবং প্রতিসরণের সূত্রগুলো (যেমন, স্নেলের সূত্র) প্রমাণ করা যায়। যখন একটি তরঙ্গমুখ একটি পৃষ্ঠে আপতিত হয়, তখন প্রতিটি আপতিত বিন্দু থেকে নতুন তরঙ্গিকা নির্গত হয়ে প্রতিফলিত বা প্রতিসৃত তরঙ্গমুখ তৈরি করে।
  • অপবর্তন: যখন আলো কোনো ক্ষুদ্র ফাঁক বা ধারালো কিনারা দিয়ে যায়, তখন হাইগেন্সের নীতি অনুযায়ী, সেই ফাঁক বা কিনারার প্রতিটি বিন্দু নতুন উৎস হিসেবে কাজ করে এবং আলো জ্যামিতিক ছায়া অঞ্চলে বেঁকে যায়। এটি অপবর্তন ব্যাখ্যা করে।

 আলোর সমাবর্তন, অপবর্তন ও ব্যাতিচার বলতে কী বুঝায়? এদের শ্রেণীবিন্যাস ব্যাখ্যা কর ও শর্তসমূহ লিখ।

আলোর সমাবর্তন, অপবর্তন এবং ব্যাতিচার হলো আলোর তরঙ্গ ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। এই ঘটনাগুলো আলোর কণা ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

ক) আলোর ব্যাতিচার (Interference of Light):

আলোর ব্যাতিচার (Interference of Light)

ব্যাখ্যা: যখন দুটি সুসংগত (coherent) আলোক উৎস থেকে নির্গত তরঙ্গগুলো একই সময়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হয়, তখন তাদের উপরিপাতনের (superposition) ফলে আলোর তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। এই ঘটনাকে আলোর ব্যাতিচার বলে।

শর্ত:

  • সুসংগত উৎস: দুটি উৎসের কম্পাঙ্ক একই হতে হবে এবং তাদের দশা পার্থক্য (phase difference) স্থির থাকতে হবে বা শূন্য হতে হবে।
  • একবর্ণী আলো: উৎস থেকে নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য একই হতে হবে।
  • ক্ষুদ্র উৎস: উৎসগুলো ক্ষুদ্র হতে হবে (বিন্দু উৎস)।
  • ক্ষুদ্র ব্যবধান: দুটি উৎসের মধ্যবর্তী দূরত্ব খুব কম হতে হবে।
  • পর্যাপ্ত প্রস্থচ্ছেদ: আলোকের পথগুলোর প্রস্থচ্ছেদ পর্যাপ্ত হতে হবে।

শ্রেণীবিন্যাস:

ব্যাতিচার প্রধানত দুই প্রকার:

গঠনমূলক ব্যাতিচার (Constructive Interference)
ধ্বংসাত্মক ব্যাতিচার (Destructive Interference)

  1. গঠনমূলক ব্যাতিচার (Constructive Interference): যখন দুটি তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পায় (তরঙ্গের শীর্ষের সাথে শীর্ষ বা খাদের সাথে খাদ মিলিত হয়)।
  2. ধ্বংসাত্মক ব্যাতিচার (Destructive Interference): যখন দুটি তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে আলোর তীব্রতা হ্রাস পায় (তরঙ্গের শীর্ষের সাথে খাদ মিলিত হয়)।

উদাহরণ: সাবানের বুদবুদের রঙিন আলো, তেলের ওপর আলোর ঝলকানি, ইয়ং-এর দ্বি-চির পরীক্ষা।

খ) আলোর অপবর্তন (Diffraction of Light):

আলোর অপবর্তন (Diffraction of Light)

ব্যাখ্যা: যখন আলো কোনো প্রতিবন্ধকের ধার ঘেঁষে যায় অথবা কোনো ক্ষুদ্র ছিদ্র বা ফাঁকের মধ্য দিয়ে যায়, তখন এটি জ্যামিতিক ছায়া অঞ্চলে বেঁকে যায় বা ছড়িয়ে পড়ে। আলোর এই বেঁকে যাওয়ার ঘটনাকে আলোর অপবর্তন বলে।

শর্ত:

  • ছিদ্র বা প্রতিবন্ধকের আকার: ছিদ্র বা প্রতিবন্ধকের আকার আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি হতে হবে।
  • একবর্ণী আলো: একবর্ণী আলো ব্যবহার করলে অপবর্তন প্যাটার্ন পরিষ্কার হয়।

শ্রেণীবিন্যাস:

অপবর্তন প্রধানত দুই প্রকার:

  1. ফ্রেনেল অপবর্তন (Fresnel Diffraction): যখন আলোক উৎস বা পর্দা চির (slit) থেকে সসীম দূরত্বে থাকে এবং আপতিত ও অপবর্তিত তরঙ্গমুখগুলো সমতল না হয়।
  2. ফ্রনহফার অপবর্তন (Fraunhofer Diffraction): যখন আলোক উৎস এবং পর্দা চির থেকে অসীম দূরত্বে থাকে (বা লেন্স ব্যবহার করে অসীম দূরত্বে ফোকাস করা হয়) এবং আপতিত ও অপবর্তিত তরঙ্গমুখগুলো সমতল হয়। এটি সবচেয়ে সাধারণ প্রকারের অপবর্তন যা ল্যাবরেটরিতে দেখা যায়।

উদাহরণ: CD/DVD তে আলোর রামধনু রঙের ঝলকানি, মেঘের চারপাশের আলোর বলয় (করোনা), লেজার লাইটের প্যাটার্ন।

গ) আলোর সমাবর্তন (Polarization of Light):

আলোর সমাবর্তন (Polarization of Light)

ব্যাখ্যা: সাধারণ আলোতে তড়িৎ ভেক্টর এবং চৌম্বক ভেক্টর কম্পন তরঙ্গের গতিপথের সাথে লম্বভাবে সব দিকে দোদুল্যমান থাকে। যখন এই কম্পনগুলো একটি নির্দিষ্ট সমতলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন আলোর এই ঘটনাকে আলোর সমাবর্তন বলে।

শর্ত:

  • অনুপ্রস্থ তরঙ্গ: সমাবর্তন কেবল অনুপ্রস্থ (transverse) তরঙ্গের ক্ষেত্রেই সম্ভব। আলো একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গ, তাই এর সমাবর্তন হয়। শব্দ তরঙ্গ অনুদৈর্ঘ্য হওয়ায় এর সমাবর্তন হয় না।
  • পোলারাইজার: আলোকে সমাবর্তিত করার জন্য পোলারাইজার (যেমন, পোলারয়েড ফিল্টার) প্রয়োজন।

শ্রেণীবিন্যাস:

সমাবর্তন বিভিন্ন প্রকার হতে পারে:

  1. রৈখিক সমাবর্তন (Linear Polarization): যখন তড়িৎ ভেক্টরের কম্পন একটি নির্দিষ্ট সমতলে সীমাবদ্ধ থাকে।
  2. বৃত্তাকার সমাবর্তন (Circular Polarization): যখন তড়িৎ ভেক্টরের শীর্ষ তরঙ্গের গতিপথ বরাবর একটি বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে।
  3. উপবৃত্তাকার সমাবর্তন (Elliptical Polarization): যখন তড়িৎ ভেক্টরের শীর্ষ তরঙ্গের গতিপথ বরাবর একটি উপবৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে।

উদাহরণ: পোলারয়েড সানগ্লাস (যা আলোর ঝলকানি কমাতে সাহায্য করে), থ্রিডি (3D) সিনেমা, এলসিডি (LCD) ডিসপ্লে।

Scroll to Top