চুম্বক কাকে বলে?

চুম্বক হলো এমন একটি বস্তু যা লোহা, নিকেল, কোবাল্ট এবং কিছু বিশেষ সংকর ধাতুকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর দুটি মেরু থাকে – উত্তর মেরু (North Pole) এবং দক্ষিণ মেরু (South Pole)। একই মেরুগুলো পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীত মেরুগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করে। সহজভাবে, যে-সব পদার্থের আকর্ষণী বা দিক নির্দেশক ধর্ম রয়েছে সে সব পদার্থকে চুম্বক বলে। চুম্বকের এই আকর্ষণ ও দিক নির্দেশক ধর্মকে চুম্বকত্ব বলে।

চৌম্বক পদার্থের শ্রেণীবিভাগ

চৌম্বক ধর্ম ও চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে চৌম্বক পদার্থকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

 ডায়াচৌম্বক পদার্থ (Diamagnetic Materials):

চৌম্বক পদার্থের শ্রেণীবিভাগ

যে সব পদার্থকে চৌম্বকক্ষেত্রে স্থাপন করা হলে চুম্বকায়নকারী ক্ষেত্রের বিপরীত দিকে সামান্য চুম্বকত্ব লাভ করে তাদেরকে ডায়াচৌম্বক পদার্থ বলে। এদের মধ্যে কোনো স্থায়ী চৌম্বকীয় দ্বিমেরু (magnetic dipole) থাকে না। যখন এদেরকে চৌম্বক ক্ষেত্রে স্থাপন করা হয়, তখন ইলেকট্রনের কক্ষীয় গতির পরিবর্তনের কারণে দুর্বল চৌম্বকীয় দ্বিমেরুর সৃষ্টি হয় যা প্রযুক্ত ক্ষেত্রের বিপরীত দিকে মুখ করে থাকে। এই কারণে তারা বিকর্ষিত হয়।

উদাহরণ: তামা (Copper), বিসমাথ (Bismuth), সোনা (Gold), রূপা (Silver), পানি (Water), হিলিয়াম (Helium)।

প্যারাচৌম্বক পদার্থ (Paramagnetic Materials):

যে সব পদার্থকে চৌম্বকক্ষেত্রে স্থাপন করা হলে চুম্বকায়নকারী ক্ষেত্রের দিকে সামান্য চুম্বকত্ব লাভ করে তাদেরকে প্যারাচৌম্বক পদার্থ বলে। এদের পরমাণুতে এক বা একাধিক অযুগ্ম ইলেকট্রন থাকার কারণে স্থায়ী চৌম্বকীয় দ্বিমেরু থাকে। তবে সাধারণ অবস্থায় এই দ্বিমেরুগুলো এলোমেলোভাবে সজ্জিত থাকায় পদার্থের সামগ্রিক চৌম্বকত্ব শূন্য থাকে। যখন এদেরকে চৌম্বক ক্ষেত্রে স্থাপন করা হয়, তখন এই দ্বিমেরুগুলো প্রযুক্ত ক্ষেত্রের দিকে সামান্য সজ্জিত হওয়ার চেষ্টা করে, ফলে পদার্থ সামান্য আকৃষ্ট হয়। ক্ষেত্র সরিয়ে নিলে এই সজ্জা নষ্ট হয়ে যায়।

উদাহরণ: অ্যালুমিনিয়াম (Aluminum), প্লাটিনাম (Platinum), অক্সিজেন (Oxygen), সোডিয়াম (Sodium), তরল অক্সিজেন।

ফেরোচৌম্বক পদার্থ (Ferromagnetic Materials): 

ফেরোচৌম্বক পদার্থ (Ferromagnetic Materials)

যে সব পদার্থকে চৌম্বকক্ষেত্রে স্থাপন করা হলে চুম্বকায়নকারী ক্ষেত্রের দিকে শক্তিশালী  চুম্বকত্ব লাভ করে তাদেরকে  ফেরোচৌম্বক পদার্থ বলে। পদার্থগুলো চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয় এবং ক্ষেত্র সরিয়ে নিলেও তাদের মধ্যে স্থায়ী চৌম্বকত্ব বজায় থাকে। এদের পরমাণুতে শক্তিশালী আন্তঃপারমাণবিক মিথষ্ক্রিয়ার কারণে চৌম্বকীয় দ্বিমেরুগুলো ছোট ছোট অঞ্চলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একই দিকে সজ্জিত থাকে। এই অঞ্চলগুলোকে চৌম্বক ডোমেইন বলা হয়। যখন এদেরকে চৌম্বক ক্ষেত্রে স্থাপন করা হয়, তখন ডোমেইনগুলো ক্ষেত্রের দিকে বৃদ্ধি পায় এবং সজ্জিত হয়, ফলে শক্তিশালী আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ: লোহা (Iron), নিকেল (Nickel), কোবাল্ট (Cobalt), এবং এদের সংকর (যেমন: ইস্পাত)।

কুরী তাপমাত্রা কাকে বলে? 

তাপমাত্রার একটি নির্দিষ্ট মান অতিক্রম করলেই ফেরোচৌম্বক পদার্থ চুম্বকত্ব হারায়। এই তাপমাত্রাকে কুরী তাপমাত্রা বলে। 

চৌম্বক ক্ষেত্র ও চৌম্বক প্রাবল্য

চৌম্বক ক্ষেত্র (Magnetic Field):

চৌম্বক ক্ষেত্র (Magnetic Field)

কোনো চুম্বকের চারপাশে যে অঞ্চলে অন্য কোনো চুম্বক বা চৌম্বক পদার্থ আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল অনুভব করে, সেই অঞ্চলকে চৌম্বক ক্ষেত্র বলে। চৌম্বক ক্ষেত্র একটি ভেক্টর রাশি, এর মান ও দিক উভয়ই আছে। চৌম্বক ক্ষেত্রের দিককে চৌম্বক বলরেখা (magnetic field lines) দ্বারা নির্দেশিত করা হয়। এই বলরেখাগুলো উত্তর মেরু থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ মেরুতে শেষ হয় এবং চুম্বকের অভ্যন্তরে দক্ষিণ মেরু থেকে উত্তর মেরুর দিকে প্রসারিত থাকে। চৌম্বক ক্ষেত্রের তীব্রতা সাধারণত টেসলা (Tesla, T) এককে পরিমাপ করা হয়।

চৌম্বক প্রাবল্য (Magnetic Field Intensity) :

কোনো স্থানে চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টিকারী বাহ্যিক উৎসের (যেমন: তড়িৎ প্রবাহ) প্রভাবকে চৌম্বক প্রাবল্য বা চৌম্বক ক্ষেত্র শক্তি বলে। একে সাধারণত H দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং এর একক হলো অ্যাম্পিয়ার/মিটার (A/m)। চৌম্বক প্রাবল্য মাধ্যম নিরপেক্ষ, অর্থাৎ এটি মাধ্যমের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে না।

চৌম্বক ক্ষেত্র (B) এবং চৌম্বক প্রাবল্যের (H) মধ্যে সম্পর্ক হলো:

B = μH = μ0​(1+χm​)H

যেখানে,

  • μ হলো মাধ্যমের চৌম্বক ভেদ্যতা (permeability)।
  • μ0 হলো শূন্যস্থানের চৌম্বক ভেদ্যতা (4π×10-7T m/A)।
  • χm​ হলো মাধ্যমের চৌম্বক সংবেদনশীলতা (magnetic susceptibility)।

ডায়াচৌম্বক, প্যারাচৌম্বক ও ফেরোচৌম্বক পদার্থের মধ্যে তুলনা

বৈশিষ্ট্য ডায়াচৌম্বক পদার্থ প্যারাচৌম্বক পদার্থ ফেরোচৌম্বক পদার্থ
চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব সামান্য বিকর্ষিত হয় সামান্য আকৃষ্ট হয় তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয়
স্থায়ী দ্বিমেরু পরমাণুতে স্থায়ী চৌম্বকীয় দ্বিমেরু থাকে না পরমাণুতে স্থায়ী চৌম্বকীয় দ্বিমেরু থাকে পরমাণুতে শক্তিশালী আন্তঃপারমাণবিক মিথষ্ক্রিয়ার কারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সজ্জিত দ্বিমেরু থাকে
আপেক্ষিক ভেদ্যতা (μr) 1 এর চেয়ে সামান্য কম (μr​<1) 1 এর চেয়ে সামান্য বেশি (μ​r>1) 1 এর চেয়ে অনেক বেশি (μr​>>1)
চৌম্বক সংবেদনশীলতা (χm​) ঋণাত্মক এবং ক্ষুদ্র χm<0 ধনাত্মক ও ক্ষুদ্র বড় ও ধনাত্মক
তাপমাত্রা প্রভাব তাপমাত্রা পরিবর্তনে খুব সামান্য প্রভাব পড়ে তাপমাত্রা বাড়লে চৌম্বকত্ব কমে কুরি তাপমাত্রার উপরে প্যারাচৌম্বক আচরণ করে
চৌম্বকত্ব প্রযুক্ত ক্ষেত্রের উপর রৈখিকভাবে নির্ভরশীল প্রযুক্ত ক্ষেত্রের উপর রৈখিকভাবে নির্ভরশীল অ-রৈখিক সম্পর্ক দেখা যায় এবং হিস্টেরেসিস লুপ তৈরি করে
উদাহরণ তামা, বিসমাথ, সোনা, রূপা, পানি, হিলিয়াম অ্যালুমিনিয়াম, প্লাটিনাম, অক্সিজেন, সোডিয়াম, তরল অক্সিজেন লোহা, নিকেল, কোবাল্ট, ইস্পাত

চৌম্বক ডোমেইন কী? আলোচনা করো

চৌম্বক ডোমেইন কী? আলোচনা করো

ফেরোচৌম্বক পদার্থের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলকে চৌম্বক ডোমেইন (Magnetic Domain) বলা হয়। প্রতিটি ডোমেইনে পরমাণুর চৌম্বকীয় দ্বিমেরুগুলো শক্তিশালী আন্তঃপারমাণবিক মিথষ্ক্রিয়ার কারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একই দিকে সমান্তরালভাবে সজ্জিত থাকে। এর ফলে প্রতিটি ডোমেইন একটি ক্ষুদ্র চুম্বক হিসেবে আচরণ করে এবং একটি নির্দিষ্ট দিকে শক্তিশালী চৌম্বক মোমেন্ট ধারণ করে।

সাধারণ অবস্থায়, যখন কোনো ফেরোচৌম্বক পদার্থের উপর বাহ্যিক চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয় না, তখন এই ডোমেইনগুলোর চৌম্বক মোমেন্টগুলো এলোমেলোভাবে সজ্জিত থাকে। ফলে পদার্থের সামগ্রিক চৌম্বক মোমেন্ট প্রায় শূন্য হয়।

যখন একটি বাহ্যিক চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয়, তখন দুটি প্রধান প্রক্রিয়া ঘটে:

১. ডোমেইন প্রাচীরের সরণ (Domain Wall Motion): যে ডোমেইনগুলোর চৌম্বক মোমেন্ট প্রযুক্ত ক্ষেত্রের দিকে বা তার কাছাকাছি থাকে, সেই ডোমেইনগুলো আকারে বৃদ্ধি পায় এবং যাদের মোমেন্ট বিপরীত দিকে থাকে, সেই ডোমেইনগুলো সংকুচিত হয়। ডোমেইন প্রাচীর স্থানান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে এই পরিবর্তন ঘটে।

২. ডোমেইন ঘূর্ণন (Domain Rotation): শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করলে, ডোমেইনগুলোর চৌম্বক মোমেন্ট ধীরে ধীরে প্রযুক্ত ক্ষেত্রের দিকে ঘুরে যায়, এমনকি তাদের প্রাথমিক সজ্জা নির্বিশেষে।

চৌম্বক ডোমেইনের ধারণা ফেরোচৌম্বক পদার্থের শক্তিশালী চৌম্বকত্বের ব্যাখ্যা দেয় এবং হিস্টেরেসিস (hysteresis) নামক চৌম্বক ধর্মের ব্যাখ্যা দিতেও সহায়ক। হিস্টেরেসিস হলো চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের সাথে চৌম্বকত্বের পিছিয়ে থাকা। ডোমেইন প্রাচীরের সরণ এবং ঘূর্ণনের কারণে চৌম্বকত্বের পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে বাহ্যিক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে পারে না, ফলে হিস্টেরেসিস লুপের সৃষ্টি হয়।

চৌম্বক ডোমেইনের আকার, আকৃতি এবং সজ্জা পদার্থের উপাদান, বিশুদ্ধতা এবং তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। ফেরোচৌম্বক পদার্থের চৌম্বক বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য ডোমেইন তত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা।

 

Scroll to Top