বল (Force) – পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা

বল (Force) হলো পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা, যা কোনো বস্তুর গতির পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। এটি একটি বাহ্যিক কারণ, যা বস্তুকে ঠেলে, টেনে বা বাঁকিয়ে তার অবস্থান বা আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে।

বল কী?

বল হলো এমন একটি ক্রিয়া, যা কোনো স্থির বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তাকে গতিশীল করে বা করতে চায় অথবা কোন গতিশীল বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তাকে স্থির করে বা করতে চায়। বলের মাত্রা (পরিমাণ) নির্ভর করে বলের মান এবং দিকের উপর। এটি একটি ভেক্টর রাশি, অর্থাৎ এর মান ও দিক উভয়ই থাকে।

বল কী?

বল পরিমাপের একক

বল পরিমাপের জন্য এসআই একক হলো নিউটন (Newton, N)। এক নিউটন বল হলো এমন একটি বল, যা ১ কেজি ভরের বস্তুকে ১ মিটার/সেকেন্ড² ত্বরণ প্রদান করে।

বল কীভাবে কাজ করে?

বল বস্তুতে বিভিন্নভাবে কাজ করতে পারে—

  1. বস্তুর গতি পরিবর্তন করে 
  2. বস্তুর দিক পরিবর্তন করে
  3. বস্তুর আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে

বল কত প্রকার?

পদার্থবিজ্ঞানে বলকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়:

১. সংযোগ বল (Contact Force)

এই ধরনের বল সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে বস্তুতে কাজ করে।
উদাহরণ:

  • ঘর্ষণ বল (Frictional Force): দুটি বস্তু পরস্পরের সংস্পর্শে এলে যে প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়।
  • স্থিতিস্থাপক বল (Elastic Force): প্রসারিত বা সংকুচিত বস্তু আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে যে বল প্রয়োগ করে।
  • প্রয়োগ বল (Applied Force): বাহ্যিক কোনো উৎস দ্বারা প্রয়োগ করা বল।

২. সংযোগবিহীন বল (Non-contact Force)

এই ধরনের বল কোনো বস্তুতে সরাসরি স্পর্শ ছাড়াই কাজ করে।
উদাহরণ:

  • মহাকর্ষ বল (Gravitational Force): পৃথিবী যে কারণে সবকিছুকে নিজের দিকে টানে।
  • তড়িৎ বল (Electrostatic Force): চার্জযুক্ত কণার মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণের ফলে সৃষ্ট বল।
  • চৌম্বক বল (Magnetic Force): চুম্বক যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে।

জড়তা (Inertia) – বস্তুর গতির স্বাভাবিক প্রবণতা

জড়তা (Inertia) হলো পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা, যা বস্তুর নিজস্ব ধর্ম বোঝায়। এটি বস্তুর সেই প্রবণতা, যার কারণে কোনো বস্তু তার বর্তমান গতিশীলতা বা স্থিরতা বজায় রাখতে চায়, যতক্ষণ না বাহ্যিক কোনো বল তা পরিবর্তন করে।

জড়তা কী?

জড়তা হলো বস্তুর সেই ধর্ম, যার ফলে এটি বাহ্যিক বল প্রয়োগ না করা পর্যন্ত তার বর্তমান অবস্থা বজায় রাখে।

  • যদি কোনো বস্তু স্থির থাকে, তাহলে এটি বাহ্যিক বল না পাওয়া পর্যন্ত স্থিরই থাকবে।
  • যদি কোনো বস্তু গতিশীল থাকে, তাহলে এটি একই দিক ও গতিতে চলতে থাকবে, যতক্ষণ না কোনো বাহ্যিক বল তার গতি পরিবর্তন করে।
জড়তা কী?

নিউটনের প্রথম গতি সূত্র ও জড়তা

জড়তার ধারণা ব্যাখ্যা করতে স্যার আইজ্যাক নিউটন তার প্রথম গতি সূত্র প্রদান করেন, যা জড়তার সূত্র (Law of Inertia) নামে পরিচিত।

নিউটনের প্রথম গতি সূত্র:
“কোনো বস্তু বাহ্যিক বলের অনুপস্থিতিতে যদি স্থির থাকে, তবে সেটি স্থিরই থাকবে; আর যদি গতি সম্পন্ন থাকে, তবে সেটি একই বেগে ও একই দিকে গতিশীল থাকবে।”

এটি বোঝায় যে বস্তু স্বাভাবিকভাবে তার গতিশীলতা পরিবর্তন করতে চায় না, যা তার জড়তার কারণেই হয়।

জড়তার প্রকারভেদ

জড়তা সাধারণত তিন প্রকারের হতে পারে—

১. বিশ্রামের জড়তা (Inertia of Rest)

  • কোনো বস্তু স্বাভাবিকভাবে বিশ্রাম বা স্থির অবস্থায় থাকতে চায় এবং বাহ্যিক বল প্রয়োগ না করা পর্যন্ত সেটি স্থিরই থাকবে।
    উদাহরণ:
  • একটি বই টেবিলে রাখা থাকলে, সেটি নিজে থেকে নড়বে না।
  • গাড়িতে বসে থাকা অবস্থায় গাড়ি হঠাৎ চলতে শুরু করলে পিছনের দিকে ঝাঁকুনি লাগে।

২. গতির জড়তা (Inertia of Motion)

  • যদি কোনো বস্তু গতিশীল থাকে, তাহলে সেটি বাহ্যিক বল না পাওয়া পর্যন্ত একই গতিতে চলতে থাকবে।
    উদাহরণ:
  • চলন্ত বাস বা ট্রেন হঠাৎ ব্রেক করলে যাত্রীরা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
  • ফুটবলে কিক না মারা পর্যন্ত সেটি চলতেই থাকবে (যতক্ষণ না মাটির ঘর্ষণ বা বাতাসের প্রতিরোধ সেটিকে থামায়)।

৩. দিকের জড়তা (Inertia of Direction)

  • কোনো বস্তু বাহ্যিক বলের অনুপস্থিতিতে তার চলার দিক পরিবর্তন করতে চায় না।
    উদাহরণ:
  • গাড়ি বাঁক নিলে যাত্রীরা উল্টো দিকে ঝুঁকে পড়ে।
  • দ্রুতগতির বাইসাইকেল বা মোটরসাইকেল চালানোর সময় হঠাৎ বাঁক নিলে শরীর বাইরের দিকে ধাক্কা খায়।

জড়তার কারণ

জড়তা মূলত বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে। কোনো বস্তু যত ভারী হবে, তার জড়তা তত বেশি হবে। কারণ, ভারী বস্তুর গতি পরিবর্তন করতে বেশি বল প্রয়োজন হয়।

উদাহরণ:

  • একটি ফুটবল ও একটি বোলিং বলকে একসঙ্গে ধাক্কা দিলে ফুটবল সহজে গতি পাবে, কিন্তু বোলিং বলের গতি পরিবর্তন করা কঠিন হবে, কারণ বোলিং বলের জড়তা বেশি।

মৌলিক বলের প্রকৃতি

প্রকৃতির সব ধরনের বল বা শক্তি চারটি মৌলিক বলের মাধ্যমে কাজ করে। এই মৌলিক বলগুলো হলো—

  1. মহাকর্ষীয় বল
  2. তড়িৎচুম্বকীয় বল
  3. সবল নিউক্লিয় বল
  4. দুর্বল নিউক্লিয় বল

এগুলোকে মৌলিক বল বলা হয় কারণ এদের থেকে আরও ক্ষুদ্র কোনো বল পাওয়া যায়নি। এখন চলুন প্রতিটি বলের প্রকৃতি বিস্তারিতভাবে বুঝে নিই।

১. মহাকর্ষীয় বল

প্রকৃতি: মহাকর্ষীয় বল হলো আকর্ষণধর্মী বল, যা দুটি ভরযুক্ত বস্তুর মধ্যে ক্রিয়া করে। এই বলের পরিমাণ বস্তুগুলোর ভরের ওপর নির্ভর করে এবং দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে এটি কমে যায়।

মহাকর্ষীয় বল

উদাহরণ:

  • পৃথিবী যেকোনো বস্তুকে নিজের দিকে টানে, তাই আমরা ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি।
  • সূর্য মহাকর্ষের মাধ্যমে গ্রহগুলিকে কক্ষপথে ধরে রাখে।

গুরুত্ব: মহাকর্ষীয় বল মহাবিশ্বের বৃহৎ কাঠামো যেমন গ্রহ, নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির গতিবিধি নির্ধারণ করে।

২. তড়িৎচুম্বকীয় বল

প্রকৃতি: এই বল দুটি চার্জযুক্ত কণার মধ্যে কাজ করে এবং এটি আকর্ষণ বা বিকর্ষণ হতে পারে। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ একে অপরকে আকর্ষণ করে, কিন্তু একই ধরণের চার্জ একে অপরকে বিকর্ষণ করে।

তড়িৎচুম্বকীয় বল

উদাহরণ:

  • চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে।
  • বিদ্যুৎপ্রবাহযুক্ত তারের চারপাশে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়।

গুরুত্ব: তড়িৎচুম্বকীয় বল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক প্রযুক্তির ভিত্তি, যেমন— বিদ্যুৎ, চৌম্বকীয় যন্ত্রপাতি, এবং রাসায়নিক বন্ধন (যা বস্তু গঠনে সহায়তা করে)।

৩. সবল নিউক্লিয় বল

প্রকৃতি: এটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিউট্রন ও প্রোটনকে একত্রে ধরে রাখে। এটি চারটি মৌলিক বলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, তবে এটি কেবলমাত্র ক্ষুদ্র পরিসরে (প্রায় ১০⁻¹⁵ মিটার) কাজ করে।

উদাহরণ:

  • পরমাণুর নিউক্লিয়াস একত্রে থাকার কারণ হলো দৃঢ় নিউক্লিয়ার বল।
  • নিউক্লিয়ার শক্তি উৎপাদনে এই বল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গুরুত্ব: এই বল পরমাণুর স্থিতিশীলতা রক্ষা করে এবং পারমাণবিক শক্তির মূল ভিত্তি।

৪. দুর্বল নিউক্লিয় বল

প্রকৃতি: এটি পরমাণুর নির্দিষ্ট কণার ক্ষয় বা রূপান্তরের (radioactive decay) জন্য দায়ী।

উদাহরণ:

  • বেটা ক্ষয় (Beta Decay), যেখানে একটি নিউট্রন এক প্রোটনে পরিণত হয় এবং ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো নির্গত হয়।
  • নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অংশে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গুরুত্ব: দুর্বল নিউক্লিয়ার বল পারমাণবিক বিক্রিয়া ও নক্ষত্রের শক্তি উৎপাদনে সহায়ক।

সাম্যতা ও সাম্যহীন বল

সাম্যতা (Equilibrium) কী?

যখন কোনো বস্তুতে প্রয়োগ করা সমস্ত বল একে অপরকে বাতিল করে দেয় এবং বস্তুটি স্থির থাকে বা অভ্যাসগত গতিতে চলতে থাকে, তখন একে সাম্যাবস্থায় (Equilibrium) বলা হয়। অর্থাৎ, বস্তুটির উপর ক্রিয়াশীল সব বলের সমষ্টি শূন্য হয়।

সাম্যতা (Equilibrium) কী?

সাম্যের বৈশিষ্ট্য:

  1. বস্তুটি স্থির থাকবে অথবা একই গতিতে চলতে থাকবে।
  2. বস্তুটির উপর কোনো নিট বল (Net Force) কাজ করবে না।
  3. গাণিতিকভাবে, যদি ∑F = 0 হয়, তবে বস্তুটি সাম্যাবস্থায় থাকবে।

সাম্যের প্রকারভেদ:

সাম্যতা সাধারণত দুই প্রকার—

  1. স্থিতিশীল সাম্যাবস্থা (Static Equilibrium): যদি কোনো বস্তু স্থির থাকে এবং তার উপর কোনো বাহ্যিক বল কাজ না করে, তবে একে স্থিতিশীল সাম্যাবস্থা বলা হয়। যেমন: টেবিলের উপর রাখা বই।
  2. গতিশীল সাম্যাবস্থা (Dynamic Equilibrium): যদি কোনো বস্তু নির্দিষ্ট বেগে ও সরলরৈখিক পথে গতিশীল থাকে এবং তার উপর কোনো নিট বল কাজ না করে, তবে সেটি গতিশীল সাম্যাবস্থায় থাকবে। যেমন: বাতাসে স্থিরগতিতে উড়তে থাকা বিমান।

সাম্যহীন বল (Unbalanced Force) কী?

যখন কোনো বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল বলসমূহ একে অপরকে বাতিল করতে পারে না এবং বস্তুটির গতির পরিবর্তন ঘটে, তখন একে সাম্যহীন বল বলা হয়।

সাম্যহীন বলের বৈশিষ্ট্য:

  1. বস্তুটি স্থির থাকলে সেটি নড়াচড়া শুরু করবে।
  2. যদি বস্তুটি চলমান থাকে, তবে তার বেগ বা দিক পরিবর্তিত হবে।
  3. গাণিতিকভাবে, যদি ∑F ≠ 0 হয়, তবে বস্তুটির উপর সাম্যহীন বল কাজ করছে।

সাম্যহীন বলের উদাহরণ:

  1. একজন ব্যক্তি যখন ধাক্কা দিলে গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
  2. ফুটবলার যখন বলকে লাথি মারলে তা গতি পরিবর্তন করে।
  3. ফল মাটিতে পড়ার সময় মাধ্যাকর্ষণ বল কাজ করে।

ভরবেগ (Momentum) কী?

ভরবেগ (Momentum) পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা কোনো বস্তুর ভর ও গতির সংমিশ্রণে গঠিত হয়। এটি বস্তুর গতিশীলতার পরিমাণ বোঝায় এবং বল প্রয়োগের ফলে পরিবর্তিত হতে পারে।

ভরবেগের সংজ্ঞা

কোনো বস্তুর ভর (Mass) ও তার বেগের (Velocity) গুণফলকে ভরবেগ বলা হয়। এটি একটি ভেক্টর রাশি, যার দিক বস্তুর গতির দিকের সাথে একীভূত থাকে।

গাণিতিকভাবে,

P = mv

যেখানে,
p = ভরবেগ (Momentum)
m = বস্তুটির ভর (Mass)
v = বস্তুটির বেগ (Velocity)

ভরবেগের একক কিলোগ্রাম-মিটার প্রতি সেকেন্ড (kg·m/s)।

ভরবেগের বৈশিষ্ট্য

  1. ভরবেগ একটি ভেক্টর রাশি, তাই এর দিক ও মান উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
  2. বস্তু যত ভারী হবে বা যত বেশি গতিশীল হবে, তার ভরবেগ তত বেশি হবে।
  3. কোনো বস্তুর উপর বাহ্যিক বল প্রয়োগ করলে তার ভরবেগ পরিবর্তিত হয়।

ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র (Law of Conservation of Momentum)

নিউটনের গতিসূত্র অনুসারে, যদি কোনো বন্ধ সিস্টেমে বাহ্যিক বল কাজ না করে, তাহলে ভরবেগ অপরিবর্তিত থাকে। অর্থাৎ, সংঘর্ষ বা বিস্ফোরণের সময়ও মোট ভরবেগ পরিবর্তন হয় না।

গাণিতিকভাবে, m1u1+m2u2 = m1v1+m2v2

যেখানে,
m1,m2 = সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারী বস্তুর ভর
u1,u2 = সংঘর্ষের পূর্বের বেগ
v1,v2 = সংঘর্ষের পরবর্তী বেগ

ভরবেগের বাস্তব প্রয়োগ

  • গাড়ির সিটবেল্ট ও এয়ারব্যাগ:
    • দুর্ঘটনার সময় যাত্রীরা তাদের ভরবেগের কারণে সামনের দিকে ধাবিত হয়।
    • সিটবেল্ট ও এয়ারব্যাগ ধীরে ধীরে ভরবেগ কমিয়ে দুর্ঘটনার আঘাত কমায়।
  • ফুটবল ও ক্রিকেটে বলের গতি পরিবর্তন:
    • ফুটবলার যখন বলকে লাথি দেয়, তখন তার ভরবেগ পরিবর্তিত হয়।
    • ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান ব্যাটের সাহায্যে বলের ভরবেগ পরিবর্তন করে শট খেলে।
  • বক্সিং ও মার্শাল আর্ট:
    • ঘুষি বা লাথির শক্তি ভরবেগের উপর নির্ভর করে।
    • খেলোয়াড়রা হাত ও শরীরের ওজন ও গতি ব্যবহার করে আঘাতের শক্তি বাড়ায়।
  • ট্রেন ও ভারী যানবাহনের ব্রেকিং সিস্টেম:
    • ট্রেন ও ট্রাকের ভর বেশি হওয়ায় তাদের ভরবেগও বেশি থাকে।
    • ফলে এগুলো থামাতে শক্তিশালী ব্রেকিং সিস্টেমের প্রয়োজন হয়।
  • ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং কৌশল:
    • ব্যাটসম্যান ব্যাটের গতি বাড়িয়ে বলকে বেশি দূরে পাঠায়।
    • ব্যাটের ভর ও গতির সমন্বয়ে ভরবেগ বৃদ্ধি পায়।
  • ট্র্যাম্পোলিনে লাফানো:
    • নিচে নামার সময় ভরবেগ বেশি হয়, যা প্রতিক্রিয়া হিসেবে উপরের দিকে ফিরে যায়।
  • রকেট উৎক্ষেপণ:
    • রকেট থেকে নির্গত গ্যাস বিপরীত দিকে ধাক্কা দেয়।
    • ফলে ভরবেগ সংরক্ষণ সূত্র অনুযায়ী রকেট উপরের দিকে উঠে যায়।
  • সাঁতারুদের দেয়াল ঠেলে এগিয়ে যাওয়া:
    • দেয়ালে পা দিয়ে ধাক্কা দিলে বিপরীত দিকে ভরবেগ তৈরি হয়, যা সাঁতারুদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
  • বরফের উপর স্কেটিং:
    • স্কেটার পা দিয়ে পিছনে ঠেলে দিলে বিপরীত দিকে ভরবেগ পায় এবং সামনে এগিয়ে যায়।
  • বাস্কেটবল ও টেবিল টেনিসে প্রতিক্রিয়া বল:
    • খেলোয়াড় যখন বলকে আঘাত করে, তখন বলের ভরবেগ পরিবর্তন হয়।
    • শক্তিশালী শট মারতে হলে বলের ভরবেগ বাড়াতে হয়।

বস্তুর গতির উপর বলের প্রভাব: 

নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের সংজ্ঞা

নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী, কোনো বস্তুর গতির পরিবর্তনের হার (ত্বরণ) তার উপর ক্রিয়াশীল বলের সমানুপাতিক এবং বস্তুর ভরের ব্যস্তানুপাতিক। সহজ ভাষায়, বল বেশি হলে বস্তু দ্রুত গতিশীল হবে, আর ভর বেশি হলে বলের প্রভাব তুলনামূলক কম হবে।

গাণিতিকভাবে, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র প্রকাশ করা হয়—

F = ma

যেখানে,
F = বল (Force), একক: নিউটন (N)
m = বস্তুটির ভর (Mass), একক: কিলোগ্রাম (kg)
a = বস্তুটির ত্বরণ (Acceleration), একক: মিটার/সেকেন্ড² (m/s²)

এই সূত্র থেকে বোঝা যায়—

  • যদি একই ভরের বস্তুতে বেশি বল প্রয়োগ করা হয়, তাহলে এটি বেশি ত্বরিত হবে।
  • যদি একই বল ভিন্ন ভরের বস্তুর উপর প্রয়োগ করা হয়, তাহলে হালকা বস্তু বেশি ত্বরিত হবে, আর ভারী বস্তু কম ত্বরিত হবে।

বস্তুর গতির উপর বলের প্রভাব

1. বলের অভাবে বস্তু স্থির বা অভ্যাসগত গতিতে থাকবে

  • যদি কোনো বস্তুতে বাহ্যিক বল প্রয়োগ না করা হয়, তবে এটি স্থির থাকবে বা সমবেগে চলতে থাকবে (নিউটনের প্রথম সূত্র অনুসারে)।
  • উদাহরণ: মহাশূন্যে ভাসমান একটি উপগ্রহ কোনো বাহ্যিক বল না থাকায় একই গতিতে চলতে থাকে।

2. বল প্রয়োগ করলে বস্তু ত্বরণ অর্জন করে

  • বল বস্তুতে ত্বরণ সৃষ্টি করে, যার মান বলের সাথে সমানুপাতিক।
  • উদাহরণ: ফুটবল খেলোয়াড় যখন বলকে লাথি দেয়, তখন বলের গতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়।

3. বেশি ভরের বস্তুর গতির পরিবর্তন কম হয়

  • একই বল প্রয়োগ করলে হালকা বস্তু বেশি ত্বরিত হয়, কিন্তু ভারী বস্তু তুলনামূলক কম ত্বরিত হয়।
  • উদাহরণ: একটি ছোট বল ও একটি ভারী বোলিং বলকে একই শক্তিতে ধাক্কা দিলে ছোট বল অনেক বেশি গতি অর্জন করে, কিন্তু বোলিং বলের গতি কম পরিবর্তিত হয়।

4. বলের দিক পরিবর্তন করলে গতির দিকও পরিবর্তিত হয়

  • বল শুধু বস্তুর বেগ পরিবর্তনই করে না, বরং বস্তুর গতির দিকও পরিবর্তন করতে পারে।
  • উদাহরণ: গাড়ি বাঁক নেওয়ার সময় চালক চাকার দিকে বল প্রয়োগ করে, যার ফলে গাড়ির গতির দিক পরিবর্তিত হয়।

নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ

  • গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ:
    • ব্রেক চাপলে বল বিপরীতমুখী হয় এবং গাড়ির ত্বরণ হ্রাস পায়।
    • অ্যাক্সেলারেটর চাপলে বল সামনে থাকে, ফলে গাড়ির গতি বাড়ে।
  • মহাকাশে নভোযানের গতি পরিবর্তন:
    • মহাকাশযানের দিক পরিবর্তনের জন্য ছোট রকেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়, যা নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের ভিত্তিতে কাজ করে।

মহাকর্ষ বল (Gravitational Force) কী?

মহাকর্ষ বল হলো প্রকৃতির একটি মৌলিক বল, যা দুটি ভরের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করে। পৃথিবী আমাদেরকে তার দিকে টেনে রাখে, চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে, এবং গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে আবর্তিত হয়—এসবই মহাকর্ষ বলের কারণে ঘটে।

মহাকর্ষ বলের সংজ্ঞা

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী, মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে, যা তাদের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।

গাণিতিকভাবে, F = G m1m2 / r2

যেখানে,
F = মহাকর্ষ বল (Newton)
G = মহাকর্ষ ধ্রুবক (6.674×10−11Nm2/kg2
m1,m2 = দুটি বস্তুর ভর (kg)
r = বস্তু দুটি মধ্যে দূরত্ব (m)

মহাকর্ষ বলের বৈশিষ্ট্য

  • এটি সর্বজনীন বল, মহাবিশ্বের সব বস্তুতে কাজ করে।
  • এটি আকর্ষণমূলক, কখনো বিকর্ষণ করে না।
  • দুটি বস্তুর ভর যত বেশি হবে, তাদের মহাকর্ষ বলও তত বেশি হবে।
  • বস্তু দুটি যত দূরে থাকবে, মহাকর্ষ বল তত কম হবে।

মহাকর্ষ বলের বাস্তব প্রয়োগ

  • পৃথিবীর আকর্ষণ:
    • মাটি থেকে কিছু ছেড়ে দিলে এটি নিচে পড়ে, কারণ পৃথিবী একে আকর্ষণ করে।
    • মানুষ ও অন্যান্য বস্তু পৃথিবীর উপর স্থির থাকে।
  • গ্রহ ও উপগ্রহের গতি:
    • সূর্যের মহাকর্ষ বলের কারণে গ্রহগুলো তার চারপাশে ঘোরে।
    • পৃথিবীর মহাকর্ষ শক্তির কারণে চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে আবর্তিত হয়।
  • জোয়ার-ভাটা:
    • চাঁদের মহাকর্ষ বল সমুদ্রের পানিকে টানে, ফলে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি হয়।
    • সূর্যের মহাকর্ষ বলও জোয়ার-ভাটায় প্রভাব ফেলে।
  • মহাকাশযান ও কৃত্রিম উপগ্রহ:
    • কৃত্রিম উপগ্রহগুলো পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের কারণে তার কক্ষপথে থাকে।
    • মহাকাশচারীরা পৃথিবীর কক্ষপথে থাকলে শূন্য মাধ্যাকর্ষণ অনুভব করেন।
  • বস্তুর পতন ও গতিবিদ্যা:
    • নিউটনের সূত্র অনুযায়ী, বস্তুর ওপর পৃথিবীর মহাকর্ষ বল কাজ করে, যা তাদের পতন ঘটায়।
    • বিমান ও রকেটের ডিজাইন করার সময় মহাকর্ষ বলের প্রভাব বিবেচনা করা হয়।
  • আপেল পড়ার ঘটনা ও নিউটনের আবিষ্কার:
    • নিউটন আপেল পড়তে দেখে মহাকর্ষ বল সম্পর্কে ধারণা পান এবং মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেন।
  • খেলাধুলায় প্রভাব:
    • ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবল ইত্যাদিতে বল মাটিতে পড়ে মহাকর্ষের কারণে।
    • লং জাম্প ও হাই জাম্প খেলায় অ্যাথলেটরা মহাকর্ষ বলের প্রভাব বুঝে লাফ দেয়।
  • আকাশের বস্তুর গতি:
    • ধূমকেতু, গ্রহাণু ও উল্কাপিণ্ড মহাকর্ষ বলের কারণে নির্দিষ্ট পথে চলে।
    • গ্যালাক্সির মধ্যে নক্ষত্রগুলো মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে আবদ্ধ থাকে।

নিউটনের ৩য় সূত্র: ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সূত্র

নিউটনের তৃতীয় সূত্র পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি, যা বলে যে “প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।” সহজ ভাষায়, যখন একটি বস্তু অন্য কোনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে, তখন সেই বস্তুও সমান পরিমাণ বল বিপরীত দিকে প্রয়োগ করে।

নিউটনের ৩য় সূত্র: ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সূত্র

নিউটনের তৃতীয় সূত্রের গাণিতিক প্রকাশ

যদি প্রথম বস্তুটি (A) দ্বিতীয় বস্তুর (B) উপর বল প্রয়োগ করে, তাহলে দ্বিতীয় বস্তুটিও প্রথম বস্তুর উপর সমান ও বিপরীতমুখী বল প্রয়োগ করবে।

গাণিতিকভাবে, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র প্রকাশ করা হয় Faction = −Freaction

যেখানে,

  • Faction = ক্রিয়া বল (Action Force)
  • Freaction = প্রতিক্রিয়া বল (Reaction Force)

এই সূত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—

  • ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বল সর্বদা জোড়ায় জোড়ায় কাজ করে।
  • ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বল দুটি আলাদা বস্তুর উপর কাজ করে।
  • বলের মান সমান হলেও দিক বিপরীত হয়।

নিউটনের তৃতীয় সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ

  • হাঁটা ও দৌড়ানো:
    • পা দিয়ে মাটিকে পিছনে ঠেলে দিলে (কর্ম বল), মাটি আমাদের সামনের দিকে ঠেলে দেয় (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • নৌকা থেকে নামা:
    • কেউ নৌকা থেকে নামতে গেলে নৌকাকে পিছনে ঠেলে দেয় (কর্ম বল), ফলে নৌকাও বিপরীত দিকে সরে যায় (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • রকেট ও জেট ইঞ্জিনের গতি:
    • রকেটের জ্বালানি গ্যাস নিচের দিকে বের হয় (কর্ম বল), ফলে রকেট উপরের দিকে উঠে যায় (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • বন্দুকের রিকয়েল (পিছনে ধাক্কা):
    • গুলি ছোড়া হলে গুলি সামনে যায় (কর্ম বল), আর বন্দুক বিপরীত দিকে ধাক্কা খায় (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • সাঁতার কাটা:
    • সাঁতারু হাত দিয়ে পানিকে পিছনে ঠেলে দেয় (কর্ম বল), ফলে সে সামনে এগিয়ে যায় (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • টেবিলের উপর বই রাখা:
    • বই টেবিলের উপর নিচের দিকে বল প্রয়োগ করে (কর্ম বল), টেবিলও বইয়ের উপর বিপরীতমুখী বল দেয় (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • ফুটবলে লাথি মারা:
    • বলকে লাথি দিলে (কর্ম বল), বলও পায়ের উপর সমান ও বিপরীত বল প্রয়োগ করে (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • গাড়ি চালানো:
    • গাড়ির চাকা পেছনের দিকে মাটিতে বল প্রয়োগ করে (কর্ম বল), মাটি গাড়িকে সামনের দিকে ঠেলে দেয় (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • ব্যালুন উড়ে যাওয়া:
    • খোলা ব্যালুন থেকে বাতাস বের হলে (কর্ম বল), ব্যালুন উল্টো দিকে দ্রুত ছুটে যায় (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • পাখির উড়তে পারা:
    • পাখি ডানা ঝাপটিয়ে বাতাসকে নিচে ঠেলে দেয় (কর্ম বল), আর বাতাস পাখিকে উপরে তোলে (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • স্কেটিং বা স্কেটবোর্ড চালানো:
    • একজন স্কেটার পা দিয়ে মাটিতে ধাক্কা দিলে (কর্ম বল), মাটি তাকে বিপরীত দিকে ঠেলে দেয় (প্রতিক্রিয়া বল)।
  • দেয়ালে ধাক্কা খাওয়া:
    • কেউ যদি দেয়ালে জোরে ধাক্কা দেয় (কর্ম বল), দেয়ালও তাকে সমান ও বিপরীতমুখী বল দেয় (প্রতিক্রিয়া বল)।

ঘর্ষণ (Friction) – বস্তুর গতি নিয়ন্ত্রণকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ বল

ঘর্ষণ (Friction) হলো এক ধরনের বল, যা দুটি বস্তুর পরস্পরের সংস্পর্শে এলে তাদের গতির বিপরীত দিকে কাজ করে। এটি বস্তুর গতি কমাতে, থামাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সবকিছুতেই ঘর্ষণের প্রভাব দেখা যায়, যেমন হাঁটা, গাড়ি চালানো বা জিনিসপত্র ধরা।

ঘর্ষণ কী?

যখন দুটি বস্তু একে অপরের সংস্পর্শে আসে এবং একটি অন্যটির উপর দিয়ে সরতে চায়, তখন তাদের মধ্যে একটি প্রতিরোধকারী বল কাজ করে, যাকে ঘর্ষণ বল বলা হয়।

ঘর্ষণ বলের মূল বৈশিষ্ট্য:

  • এটি সর্বদা গতির বিপরীত দিকে কাজ করে।
  • দুটি বস্তুর পৃষ্ঠের অসামান্যতা বা অমসৃণতার কারণে এটি সৃষ্টি হয়।
  • ঘর্ষণের কারণে বস্তুর তাপ উৎপন্ন হয় (যেমন, দুটি হাত ঘষলে গরম অনুভূত হয়)।

ঘর্ষণের প্রকারভেদ

ঘর্ষণ সাধারণত চার ধরনের হয়—

১. স্থির ঘর্ষণ (Static Friction)

  • যখন কোনো বস্তু বিশ্রামে থাকে, তখন তাকে সরানোর জন্য যে ঘর্ষণ বলটি কাজ করে, তাকে স্থির ঘর্ষণ বলা হয়।
    উদাহরণ: ভারী টেবিল ঠেলার চেষ্টা করলে প্রথমে এটি নড়তে চায় না, কারণ স্থির ঘর্ষণ বেশি থাকে।

২. গতিশীল ঘর্ষণ (Kinetic Friction)

  • যখন কোনো বস্তু একবার গতিশীল হয়ে যায়, তখন তার গতির বিপরীত দিকে যে ঘর্ষণ বল কাজ করে, সেটি গতিশীল ঘর্ষণ।
    উদাহরণ: মাটির উপর দিয়ে একটি বই ধাক্কা দিয়ে সরালে সেটি আস্তে আস্তে থেমে যাবে, কারণ গতিশীল ঘর্ষণ বল সেটির গতি কমিয়ে দেয়।

৩. ঘূর্ণন ঘর্ষণ (Rolling Friction)

  • যখন কোনো বস্তু গড়িয়ে চলে, তখন যে ঘর্ষণ বল কাজ করে, তাকে ঘূর্ণন ঘর্ষণ বলা হয়।
    উদাহরণ: গাড়ির চাকা মাটির উপর দিয়ে গড়িয়ে চলতে পারার কারণ ঘূর্ণন ঘর্ষণ। এটি সাধারণত স্থির ও গতিশীল ঘর্ষণের তুলনায় কম হয়।

৪. তরল ঘর্ষণ (Fluid Friction)

  • তরল (Liquid) বা গ্যাসের (Gas) ভেতর দিয়ে কোনো বস্তু চলার সময় যে প্রতিরোধ অনুভূত হয়, তাকে তরল ঘর্ষণ বলা হয়।
    উদাহরণ: মাছ পানির ভেতর সহজে চলতে পারে, কারণ এর দেহের গঠন তরল ঘর্ষণ কমিয়ে দেয়।

ঘর্ষণের উপকারিতা

  • হাঁটা ও দৌড়ানো সম্ভব হয়:
    • ঘর্ষণ শক্তির কারণে আমাদের পা মাটির সাথে আটকে থাকে, তাই আমরা সহজে হাঁটতে ও দৌড়াতে পারি।
  • গাড়ি ও যানবাহন চলতে পারে:
    • টায়ারের সঙ্গে রাস্তার ঘর্ষণ থাকার কারণে গাড়ি চলতে পারে ও ব্রেক করলে থেমে যায়।
  • ব্রেক কাজ করে:
    • গাড়ির ব্রেক প্যাড চাকার সাথে ঘর্ষণ তৈরি করে, ফলে গাড়ি ধীরে হয়ে থেমে যায়।
  • জিনিসপত্র ধরা সম্ভব হয়:
    • হাতের ও বস্তুগুলোর মধ্যে ঘর্ষণ থাকার কারণে আমরা কোনো কিছু সহজে ধরে রাখতে পারি।
  • লেখা ও আঁকা সম্ভব হয়:
    • কলম বা পেন্সিল কাগজের উপর ঘর্ষণ তৈরি করে, যা দিয়ে লেখা বা আঁকা সম্ভব হয়।
  • পেরেক বা স্ক্রু লাগানো যায়:
    • কাঠ বা দেয়ালে পেরেক, স্ক্রু বা নাট-বল্টু আটকে থাকে ঘর্ষণের কারণে।
  • ম্যাচ জ্বালানো যায়:
    • দেশলাই কাঠিকে রাফ (খসখসে) পৃষ্ঠের উপর ঘষলে আগুন জ্বলে ওঠে।
  • কাঠ ও ধাতুর জোড়া লাগানো যায়:
    • কাঠ, ধাতু বা অন্যান্য উপাদান একসঙ্গে আটকে রাখতে ঘর্ষণ সাহায্য করে।
  • মাথার চুল আঁচড়ানো যায়:
    • চিরুনির দাঁতের সঙ্গে চুলের ঘর্ষণের কারণে সহজে চুল আঁচড়ানো সম্ভব হয়।
  • পর্বতারোহীরা পাহাড়ে উঠতে পারে:
    • পাহাড়ের গায়ে ও জুতার মধ্যে ঘর্ষণ থাকার কারণে পর্বতারোহীরা নিরাপদে উঠতে পারে।
  • ইলেকট্রনিক ডিভাইসের তার সংযুক্ত থাকে:
    • বিদ্যুৎ সংযোগের তার সকেটে লেগে থাকে ঘর্ষণের কারণে।
  • শীতকালে হাত ঘষে গরম করা যায়:
    • দুই হাত ঘষলে ঘর্ষণ শক্তি থেকে তাপ উৎপন্ন হয়, যা শীতের দিনে হাত গরম রাখতে সাহায্য করে।
  • খেলাধুলায় নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়:
    • ফুটবল, বাস্কেটবল বা ক্রিকেটে খেলোয়াড়রা দৌড়ানোর সময় ঘর্ষণের কারণে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে।
  • সাইকেলের চেইন কাজ করে:
    • ঘর্ষণের কারণে সাইকেলের চেইন চাকার সাথে ঘুরে গতি সৃষ্টি করে।

ঘর্ষণের অপকারিতা

  • শক্তি অপচয়:
    • ঘর্ষণের কারণে অনেক সময় শক্তি হারিয়ে যায়, যেমন গাড়ি চালানোর সময় ইঞ্জিনে অতিরিক্ত শক্তি খরচ হয়।
  • যানবাহনের ক্ষয়:
    • ঘর্ষণের ফলে টায়ার, ব্রেক প্যাড, ইঞ্জিন পার্টস ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ দ্রুত ক্ষয়ে যায়।
  • গরম হওয়ার সমস্যা:
    • ঘর্ষণের কারণে গতি বৃদ্ধি হলে যন্ত্রাংশে অতিরিক্ত গরম সৃষ্টি হয়, যা তাদের কার্যকারিতা কমাতে পারে।
  • কাপড় বা জুতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়:
    • ঘর্ষণের কারণে কাপড় ও জুতার পৃষ্ঠে পরিধান হতে পারে, যা তাদের দ্রুতি ক্ষয় করে।
  • বিকৃতি বা ত্রুটি সৃষ্টি হয়:
    • মেশিন বা যন্ত্রাংশের মধ্যে অতিরিক্ত ঘর্ষণ একে বিকৃত বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
  • এনার্জি ইফিশিয়েন্সি কমে যায়:
    • অধিক ঘর্ষণ হলে যন্ত্রগুলোর এনার্জি কার্যকারিতা কমে যায়, কারণ এর ফলে অপচয় হয়।
  • গরম থেকে আগুন লাগার ঝুঁকি:
    • ঘর্ষণের ফলে অতিরিক্ত তাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা কিছু পরিস্থিতিতে আগুন লাগানোর কারণ হতে পারে।
  • শব্দ দূষণ:
    • যন্ত্রাংশের মধ্যে অতিরিক্ত ঘর্ষণ শব্দ সৃষ্টি করে, যা শব্দ দূষণ সৃষ্টি করে।
  • পরিষ্কার করা কঠিন হয়:
    • ঘর্ষণের কারণে ময়লা বা ধুলো জমতে পারে, যা পরিষ্কার করা কঠিন করে তোলে।
  • চিপ বা ফাটল সৃষ্টি হয়:
    • ঘর্ষণের ফলে বিভিন্ন পদার্থে চিপ বা ফাটল দেখা দিতে পারে, যেমন গ্লাস বা প্লাস্টিকের ওপর।
  • চাকা বা গিয়ার আটকে যাওয়ার সমস্যা:
    • অতিরিক্ত ঘর্ষণ চাকা বা গিয়ারকে আটকে ফেলতে পারে, যার ফলে যন্ত্রপাতি ঠিকমতো কাজ না করতে পারে।

ঘর্ষণ কমানোর উপায়

  • লুব্রিকেন্ট ব্যবহার:
    • তেল, গ্রিজ বা লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করে মেশিন বা যন্ত্রাংশের মধ্যে ঘর্ষণ কমানো যায়।
  • স্মুথ পৃষ্ঠ তৈরি করা:
    • পৃষ্ঠকে মসৃণ করে ঘর্ষণ কমানো যেতে পারে, যেমন জুতা বা টায়ারের তলে মসৃণতা বাড়ানো।
  • বিশেষ কোটিং ব্যবহার:
    • কিছু উপাদানের উপর বিশেষ কোটিং (যেমন টেফলন বা ডায়মন্ড-লাইক কার্বন) প্রয়োগ করলে ঘর্ষণ কমানো যায়।
  • বায়ু বা তরল ফিল্ম ব্যবহার:
    • দুই পৃষ্ঠের মধ্যে বায়ু বা তরল (যেমন পানি) ফিল্ম রেখে ঘর্ষণ কমানো সম্ভব।
  • সিলিকা বা পলিমার ব্যবহৃত উপাদান:
    • সিলিকা বা পলিমার (যেমন প্লাস্টিক) ব্যবহার করে কিছু উপাদানের মধ্যে ঘর্ষণ কমানো যায়।
  • রোলার বা বল বিয়ারিং ব্যবহার:
    • রোলার বা বল বিয়ারিং ব্যবহার করলে ঘর্ষণ কমে এবং মসৃণ গতি সৃষ্টি হয়।
  • কঠিন পৃষ্ঠের পরিবর্তে নরম পৃষ্ঠ ব্যবহার:
    • অনেক সময় নরম উপাদান (যেমন রাবার) কঠিন উপাদানের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় যাতে ঘর্ষণ কম হয়।
  • আন্তঃঘর্ষণী উপাদান নির্বাচন:
    • দুই উপাদানের মধ্যে কম ঘর্ষণীয় উপাদান নির্বাচন করলে তা ঘর্ষণ কমাতে সাহায্য করে।
  • বাতাসের চাপ প্রয়োগ:
    • অনেক সময় ঘর্ষণ কমানোর জন্য বাতাসের চাপ ব্যবহার করা হয় যাতে দুটি পৃষ্ঠ একে অপরকে স্পর্শ না করে।
  • রোটেশন বা স্কিড প্রভাব ব্যবহার:
    • কিছু যন্ত্রে রোটেশন বা স্কিড প্রভাব ব্যবহার করে ঘর্ষণ কমানো হয়।
  • আবহাওয়া ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ:
    • তাপমাত্রা কমিয়ে বা প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা তৈরি করে কিছু পরিস্থিতিতে ঘর্ষণ কমানো যায়।

 

Scroll to Top