পর্যায় সারণি বিকাশের পটভূমি
পর্যায় সারণি রসায়নের একটি অপরিহার্য ভিত্তি স্থাপনকারী সরঞ্জাম, যা মৌলসমূহকে একটি সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত করে তাদের বৈশিষ্ট্য বুঝতে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে সাহায্য করে। এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হল পর্যায় সারণির সৃষ্টির পেছনের ঐতিহাসিক যাত্রা এবং জ্ঞানভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বর্ণনা করা। বিজ্ঞানীরা কীভাবে মৌলসমূহকে বোঝা এবং সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন, সেই সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোও এখানে তুলে ধরা হবে।
প্রাচীন দর্শনে পদার্থের মৌলিক ধারণা
প্রাচীনকালেই মানুষ পদার্থের মৌলিক উপাদান সম্পর্কে ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক লিউকিপ্পাস এবং ডেমোক্রিটাস প্রথম প্রস্তাব করেন যে সমস্ত পদার্থ অবিভাজ্য ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত, যাদের তারা ‘অ্যাটমোস’ নামে অভিহিত করেছিলেন । তাদের ধারণা ছিল এই কণাগুলো বিভিন্ন আকার ও আকৃতির এবং এরা একত্রিত হয়ে বিভিন্ন পদার্থ তৈরি করে । যদিও এটি কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়নি, তবুও পদার্থের কণা তত্ত্ব সম্পর্কে তাদের এই ধারণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । পদার্থের অবিভাজ্য প্রকৃতির এই দার্শনিক উপলব্ধি পরবর্তীকালে পরমাণু তত্ত্বের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করে।
অন্যদিকে, অ্যারিস্টটল পদার্থের প্রকৃতি সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পদার্থ অবিচ্ছিন্ন এবং এটি মাটি,পানি, বায়ু এবং আগুন এই চারটি মূল উপাদান দ্বারা গঠিত । প্রাচীন বিশ্বে অ্যারিস্টটলের ব্যাপক প্রভাবের কারণে, তার এই ধারণা দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছিল এবং এটি পরমাণু তত্ত্বের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করেছিল । গ্রিকদের পাশাপাশি অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃতিতেও পদার্থের মৌলিক উপাদান নিয়ে ধারণা প্রচলিত ছিল, যেমন ভারতীয় দর্শনে পৃথিবী,পানি, আগুন, বায়ু এবং আকাশ এই পাঁচটি উপাদানকে ‘পঞ্চভূত’ বলা হত ।
প্রাচীনকাল থেকেই নয়টি মৌল পরিচিত ছিল – কার্বন, সালফার, লোহা, তামা, রূপা, টিন, সোনা, পারদ এবং সীসা । এই মৌলগুলো প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ রূপে পাওয়া যায় এবং আদিম সরঞ্জাম ব্যবহার করে এদের উত্তোলন করা তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল । মানব সমাজের প্রাথমিক পর্যায়ে এই মৌলগুলোর ব্যবহারিক এবং নান্দনিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম ।
কিছু মৌলের প্রাচীনতম ব্যবহারের সময়কাল উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রায় 40000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে সোনার ব্যবহার শুরু হয়েছিল । কার্বন, যা কাঠকয়লা এবং কালিরূপে 26000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে পরিচিত । তামার ব্যবহার প্রায় 9000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয়েছিল । সীসা 7000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে । রূপা 5000 খ্রিস্টপূর্বাব্দেরও আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় । লোহার ব্যবহারও 5000 খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে থেকে । টিন প্রায় 3500 খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম তামা মেশানোর মাধ্যমে ব্রোঞ্জ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল । সালফারের ব্যবহার অন্তত 4000 বছর আগে থেকে । পারদ 1500 খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরীয় সমাধিতে পাওয়া গেছে ।
আলকেমির যুগে আরও পাঁচটি মৌল আবিষ্কৃত হয়েছিল: দস্তা, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি এবং বিসমাথ। এছাড়াও, প্ল্যাটিনাম প্রাক-কলম্বিয়ান দক্ষিণ আমেরিকানদের কাছে পরিচিত ছিল, যদিও এটি ষোড়শ শতাব্দীর আগে ইউরোপে পৌঁছায়নি । আধুনিক রসায়নের বিকাশের আগে এই প্রাথমিক মৌলগুলোকে শনাক্ত করার পদ্ধতিগুলো মূলত পদার্থের বাহ্যিক, সহজে পর্যবেক্ষণযোগ্য বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভরশীল ছিল । নতুন পদার্থের বৈশিষ্ট্য, যেমন তার বর্ণ, গন্ধ, স্ফটিকের আকার এবং অন্যান্য পদার্থের সাথে তার বিক্রিয়া করার ক্ষমতা, এটি একটি নতুন মৌল কিনা তা নির্ধারণে সহায়ক ছিল । যদি কোনো পদার্থকে আরও সরল পদার্থে ভাঙা না যেত, তবে তাকে একটি মৌলিক পদার্থ হিসেবে গণ্য করা হত । কিছু ক্ষেত্রে, পদার্থের যৌগগুলোর রঙ এবং স্বাদ বা গন্ধও শনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত হত । উদাহরণস্বরূপ, বেরিলিয়াম লবণের মিষ্টি স্বাদ অথবা ব্রোমিনের তীব্র গন্ধ তাদের শনাক্তকরণে ভূমিকা রেখেছিল ।
এই সময়ে পারমাণবিক ভর এবং বর্ণালীবীক্ষণের মতো আধুনিক রাসায়নিক বিশ্লেষণের সরঞ্জামগুলির অভাব ছিল । ফলে, মৌল শনাক্তকরণের প্রক্রিয়াটি বেশ কঠিন ছিল এবং কখনও কখনও ভুল শনাক্তকরণ বা স্বীকৃতিতে বিলম্ব ঘটত । অনেক সময়, কোনো খনিজ আকরিকের আবিষ্কারের মাধ্যমেই নতুন মৌলের সন্ধান পাওয়া যেত, যদিও সেই আকরিকটি প্রায়শই একাধিক মৌলের মিশ্রণ থাকত ।
উনিশ শতকের পূর্বে পরিচিত মৌলসমূহ
মৌলের নাম | প্রতীক | আবিষ্কার |
সোনা | Au | 40000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
কার্বন | C | 26000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
তামা | Cu | 9000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
সীসা | Pb | 7000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
রূপা | Ag | 5000 খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে |
লোহা | Fe | 5000 খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে |
টিন | Sn | 3500 খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
সালফার | S | 2000 খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে |
পারদ | Hg | 1500 খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
দস্তা | Zn | 1000 খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে |
আর্সেনিক | As | আলকেমির যুগ |
অ্যান্টিমনি | Sb | 3000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
বিসমাথ | Bi | আলকেমির যুগ |
প্ল্যাটিনাম | Pt | ষোড়শ শতাব্দী (ইউরোপে) |
আধুনিক পর্যায় সারণির দিকে প্রথম পদক্ষেপ
অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ে:

মৌলগুলোকে শ্রেণীবদ্ধ করার প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা করেন ফরাসি রসায়নবিদ অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ের। 1789 সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ “Traite Elementaire de Chimie”-তে তিনি মৌলের একটি আধুনিক সংজ্ঞা দেন – যা কোনো সরল পদার্থকে ভাঙা যায় না । ল্যাভয়সিয়ের সেই সময়ে পরিচিত প্রায় 33টি মৌলকে তাদের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গ্যাস, অধাতু, ধাতু এবং মৃত্তিকা – এই চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করেন । তার গ্রন্থে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, ফসফরাস, পারদ, দস্তা এবং সালফারের মতো “সরল পদার্থ”-এর একটি তালিকা ছিল, যা আধুনিক মৌলের তালিকার ভিত্তি স্থাপন করে । ল্যাভয়সিয়েরের এই কাজটি আলকেমির ঐতিহ্য থেকে সরে এসে মৌলের একটি বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞা এবং শ্রেণীবদ্ধকরণের একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল ।
ইয়োহান ভোলফগ্যাং ডোবেরাইনার:

উনিশ শতকের শুরুতে, জার্মান বিজ্ঞানী ইয়োহান ভোলফগ্যাং ডোবেরাইনার মৌলগুলোকে শ্রেণীবদ্ধ করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা চালান। 1817 সাল থেকে তিনি লক্ষ্য করেন যে কিছু মৌল তিনটি করে গোষ্ঠীতে একই রকম রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, যা তিনি ত্রয়ী (Triads) নামে অভিহিত করেন । তিনি “ত্রয়ী সূত্র” প্রস্তাব করেন, যেখানে একটি ত্রয়ীর মাঝের মৌলের পারমাণবিক ভর প্রায়শই অন্য দুটি মৌলের পারমাণবিক ভরের গাণিতিক গড় হত । ডোবেরাইনারের উল্লেখযোগ্য ত্রয়ীগুলোর মধ্যে ছিল লিথিয়াম, সোডিয়াম এবং পটাসিয়াম; ক্যালসিয়াম, স্ট্রনসিয়াম এবং বেরিয়াম; ক্লোরিন, ব্রোমিন এবং আয়োডিন; এবং সালফার, সেলেনিয়াম এবং টেলুরিয়াম । ডোবেরাইনারের কাজটি মৌলগুলোর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সম্পর্ক এবং পারমাণবিক ভরের সম্ভাব্য গুরুত্ব সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিল । যদিও তার পদ্ধতিটি অসম্পূর্ণ ছিল, কারণ সেই সময়ে পরিচিত সকল মৌলকে ত্রয়ীতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি , তবুও এটি মৌল শ্রেণীবদ্ধকরণের পরবর্তী প্রচেষ্টার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল । সেই সময়ে পরিচিত ৫৩টি মৌলের মধ্যে মাত্র ৩-৫টি ত্রয়ী শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল ।
জন নিউল্যান্ডস:

১৮৬৪ সালে, জন নিউল্যান্ডস ৬২টি পরিচিত মৌলকে তাদের ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক ভর অনুসারে সাজিয়েছিলেন । তিনি লক্ষ্য করেন যে প্রতি অষ্টম মৌলের বৈশিষ্ট্য প্রথম মৌলের বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা তিনি “অষ্টক সূত্র” (Law of Octaves) নামে অভিহিত করেন এবং এটিকে সঙ্গীতের অষ্টকের সাথে তুলনা করেন । যদিও নিউল্যান্ডসের এই ধারণাটি কিছু মৌলের জন্য প্রযোজ্য ছিল, তবে ক্যালসিয়ামের পরের মৌলগুলোর ক্ষেত্রে এটি আর কাজ করেনি এছাড়াও, কিছু ভিন্নধর্মী মৌলকে একইসাথে স্থাপন করতে বাধ্য হওয়ায় এবং নতুন আবিষ্কৃত মৌলের জন্য কোনো স্থান না রাখায় তার কাজটি সমালোচিত হয়েছিল । প্রাথমিকভাবে তার কাজকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, বরং উপহাস করা হয়েছিল । তবে, নিউল্যান্ডসের অষ্টক সূত্রই প্রথম প্রচেষ্টা ছিল যেখানে সকল পরিচিত মৌলকে পারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে পর্যায় সারণির মতো বিন্যাস করা হয়েছিল এবং এটি মৌলগুলোর বৈশিষ্ট্যের পুনরাবৃত্তির ধারণা তুলে ধরেছিল ।
দে চানকুর্তোইস ও লোথার মেয়ার:

এছাড়াও, ১৮৬২ সালে দে চানকুর্তোইস “টেলুরিক স্ক্রু” নামে একটি ধারণা প্রস্তাব করেন, যেখানে তিনি পারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে মৌলগুলোকে একটি সিলিন্ডারের চারপাশে স্থাপন করেন এবং একই বৈশিষ্ট্যযুক্ত মৌলগুলো পর্যায়ক্রমে উল্লম্বভাবে দেখা যায় । লোথার মেয়ারও পারমাণবিক ভর এবং ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং ১৮৭০ সালে মেন্ডেলিফের মতোই একটি সারণি তৈরি করেছিলেন ।
দিমিত্রি মেন্ডেলিফের যুগান্তকারী সারণি:

১৮৬৯ সালে দিমিত্রি মেন্ডেলিফ একটি যুগান্তকারী কাজ করেন, যা আধুনিক পর্যায় সারণির ভিত্তি স্থাপন করে । তিনি ৬৩টি পরিচিত মৌলকে তাদের ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক ভর এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে একটি সারণিতে সাজান, যেখানে একই বৈশিষ্ট্যযুক্ত মৌলগুলো একটি নির্দিষ্ট গ্রুপে এবং ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক ভর অনুসারে সারিগুলোতে (পর্যায়) বিন্যস্ত ছিল । মেন্ডেলিফের প্রধান উদ্ভাবন ছিল তার সারণিতে তখনও আবিষ্কৃত হয়নি এমন মৌলগুলোর জন্য ফাঁকা স্থান রাখা এবং তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা । তিনি “একা-অ্যালুমিনিয়াম” (গ্যালিয়াম), “একা-সিলিকন” (জার্মেনিয়াম) এবং “একা-বোরন” (স্ক্যান্ডিয়াম)-এর মতো মৌলগুলোর অস্তিত্ব এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাদের আবিষ্কার মেন্ডেলিফের সারণির যথার্থতা প্রমাণ করে । পারমাণবিক ভরের ক্রমানুসারে সাজানোর সময়, যদি কোনো মৌলের বৈশিষ্ট্য তার প্রত্যাশিত স্থানে না মিলত, তবে মেন্ডেলিফ সেই মৌলটিকে পুনরায় বিন্যস্ত করতে দ্বিধা করেননি । মেন্ডেলিফের এই দূরদর্শিতা কেবল বিদ্যমান মৌলগুলোর জ্ঞানকে সংগঠিত করেনি, বরং ভবিষ্যতের আবিষ্কারের পথও খুলেছিল, যা তার পর্যায় সারণির ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতাকে তুলে ধরে । তবে, তার সারণিতে কিছু অসঙ্গতিও ছিল, যেমন আয়োডিন এবং টেলুরিয়ামের অবস্থান পারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত ক্রমের বিপরীত ছিল ।
হেনরি মোসলে ও আধুনিক পর্যায় সারণি:

উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের শুরুতে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রনের মতো অবপারমাণবিক কণাগুলোর আবিষ্কার পরমাণুর গঠন সম্পর্কে গভীর ধারণা প্রদান করে । ১৯১৩ সালে হেনরি মোসলে এক্স-রে ব্যবহার করে মৌলগুলোর পারমাণবিক সংখ্যা নির্ধারণ করেন । মোসলে আবিষ্কার করেন যে মৌলগুলোর বৈশিষ্ট্য আসলে তাদের পারমাণবিক সংখ্যার পর্যায়ক্রমিক ফাংশন, তাদের পারমাণবিক ভরের নয় । পারমাণবিক সংখ্যার ভিত্তিতে পর্যায় সারণিকে পুনরায় সাজানোর মাধ্যমে মোসলে মেন্ডেলিফের সারণির কিছু অসঙ্গতি (যেমন আয়োডিন এবং টেলুরিয়ামের অবস্থান) সমাধান করেন । মোসলের এই আবিষ্কার পর্যায় সারণির অন্তর্নিহিত শৃঙ্খলা বোঝার চূড়ান্ত চাবিকাঠি সরবরাহ করে এবং এর আধুনিক রূপের ভিত্তি স্থাপন করে । এমনকি একবিংশ শতাব্দীতেও নতুন মৌলের আবিষ্কারের সাথে সাথে পর্যায় সারণির সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে ।
পর্যায় সারণির ঐতিহাসিক বিকাশ প্রাচীন দার্শনিকদের প্রাথমিক ধারণা থেকে শুরু করে ল্যাভয়সিয়ের, ডোবেরাইনার, নিউল্যান্ডস, মেন্ডেলিফ এবং মোসলের মতো বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মাধ্যমে একটি অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ধারণাগুলোর এই ক্রমবিকাশ দেখায় যে কীভাবে প্রাথমিক দার্শনিক ধারণা ধীরে ধীরে পরীক্ষামূলক প্রমাণ এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তির ভিত্তিতে একটি সুসংগঠিত কাঠামো লাভ করেছে। আধুনিক রসায়নে মৌলগুলোর বৈশিষ্ট্য সংগঠিত এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য পর্যায় সারণির গুরুত্ব অপরিসীম।
পর্যায় সারণির বৈশিষ্ট্য:
-
- মৌলগুলোকে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক সংখ্যা অনুসারে সারি (পর্যায়) এবং কলামে (গ্রুপ) সাজানো হয়েছে ।
-
- বর্তমানে পর্যায় সারণিতে ৭টি পর্যায় এবং ১৮টি গ্রুপ রয়েছে ।
-
- একই গ্রুপের মৌলগুলোর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম হয় কারণ তাদের সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের সংখ্যা একই থাকে ।
-
- একই পর্যায়ের মৌলগুলোর পারমাণবিক আকার সাধারণত হ্রাস পায় এবং ধাতব বৈশিষ্ট্য কমতে থাকে ।
-
- পর্যায় সারণিতে পারমাণবিক ব্যাসার্ধ, আয়নীকরণ শক্তি, তড়িৎ ঋণাত্মকতা এবং ইলেকট্রন আসক্তির মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ক্রমিক প্রবণতা দেখা যায় ।
-
- ইলেকট্রন বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে পর্যায় সারণিকে s-ব্লক, p-ব্লক, d-ব্লক এবং f-ব্লক – এই চারটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে ।
-
- পর্যায় সারণিতে ধাতু, অধাতু এবং উপধাতুগুলোকে আলাদাভাবে দেখানো হয় ।
-
- প্রতিটি মৌলের জন্য পর্যায় সারণিতে তার প্রতীক, পারমাণবিক সংখ্যা এবং পারমাণবিক ভর উল্লেখ করা থাকে
-
- পর্যায় সারণি মৌলগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং একে অপরের সাথে তাদের সম্পর্ক বুঝতে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে সাহায্য করে ।
ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে পর্যায় সারণিতে মৌলের অবস্থান নির্ণয়:
পর্যায় সারণির গঠন বোঝা:
-
- পর্যায় সারণিকে অনুভূমিক সারি বা পর্যায় (Period) এবং উল্লম্ব স্তম্ভ বা গ্রুপ (Group) এ বিভক্ত করা হয়েছে।
-
- পর্যায় (Period):
-
- পর্যায় সারণির অনুভূমিক সারিগুলো প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা (n) দ্বারা চিহ্নিত ইলেকট্রন শেলগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ.
-
- কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বোচ্চ ‘n’ মানের শেলটি তার পর্যায় সংখ্যা নির্দেশ করে.
-
- পর্যায় (Period):
-
- গ্রুপ (Group):
-
- পর্যায় সারণির উল্লম্ব স্তম্ভগুলো গ্রুপ নামে পরিচিত এবং এদের সংখ্যা 1 থেকে 18 পর্যন্ত।
-
- একই গ্রুপের উপাদানগুলোর বাইরের ইলেকট্রন শেলগুলোতে ইলেকট্রনের সংখ্যা একই থাকে।
-
- এই ইলেকট্রনগুলোকে যোজ্যতা ইলেকট্রন বলা হয় এবং এদের সংখ্যা একটি মৌলের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।
-
- গ্রুপ (Group):
-
- ব্লক:
-
- পর্যায় সারণিকে চারটি প্রধান ব্লকে ভাগ করা যায়: s-ব্লক, p-ব্লক, d-ব্লক এবং f-ব্লক.
-
- s-ব্লক: গ্রুপ 1 এবং 2.
-
- p-ব্লক: গ্রুপ 13 থেকে 18.
-
- d-ব্লক: গ্রুপ 3 থেকে 12.
-
- f-ব্লক: ল্যান্থানাইডস এবং অ্যাক্টিনাইডস সারি.
-
- ব্লক:
ইলেকট্রন বিন্যাসের মূলনীতি
-
- ইলেকট্রন বিন্যাস হলো একটি পরমাণুর ইলেকট্রন শেল এবং সাবশেলগুলিতে ইলেকট্রনের বিন্যাস।
-
- যোজ্যতা ইলেকট্রন হলো পরমাণুর বাইরের শেলে অবস্থিত ইলেকট্রন, যা রাসায়নিক বন্ধন গঠনে অংশগ্রহণ করে।
-
- ইলেকট্রন অরবিটালগুলি আউফবাউ নীতি (Aufbau principle) অনুসারে পূর্ণ হয়.
-
- ইলেকট্রন পূরণের সাধারণ ক্রম: 1s, 2s, 2p, 3s, 3p, 4s, 3d, 4p, 5s, 4d, 5p, 6s, 4f, 5d, 6p, 7s, 5f, 6d, 7p, ইত্যাদি.
ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে পর্যায় নির্ধারণ
-
- কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বোচ্চ প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা (n) তার পর্যায় সংখ্যা নির্দেশ করে.
-
- উদাহরণ: লিথিয়াম (1s² 2s¹) – পর্যায় ২.
-
- উদাহরণ: আয়রন (1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁶ 4s² 3d⁶) – পর্যায় ৪.
-
- কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসে সর্বোচ্চ প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা (n) তার পর্যায় সংখ্যা নির্দেশ করে.
ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে ব্লক নির্ধারণ
-
- মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসের শেষ ইলেকট্রনটি যে উপশেলে (s, p, d, অথবা f) প্রবেশ করে, সেই উপশেল অনুযায়ী মৌলটির ব্লক নির্ধারিত হয়.
-
- s-ব্লক: শেষ ইলেকট্রন s-উপশেলে (ns¹ or ns²). উদাহরণ: সোডিয়াম ([Ne] 3s¹).
-
- p-ব্লক: শেষ ইলেকট্রন p-উপশেলে (ns² np¹⁻⁶) . উদাহরণ: ক্লোরিন ([Ne] 3s² 3p⁵).
-
- d-ব্লক: শেষ ইলেকট্রন d-উপশেলে ((n-1)d¹⁻¹⁰ ns⁰⁻²) . উদাহরণ: আয়রন ([Ar] 4s² 3d⁶).
-
- f-ব্লক: শেষ ইলেকট্রন f-উপশেলে ((n-2)f¹⁻¹⁴ ns²).
-
- মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসের শেষ ইলেকট্রনটি যে উপশেলে (s, p, d, অথবা f) প্রবেশ করে, সেই উপশেল অনুযায়ী মৌলটির ব্লক নির্ধারিত হয়.
ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে গ্রুপ নির্ধারণ
-
- s-ব্লক মৌল: গ্রুপ নম্বর = বাইরের s-উপশেলে যোজ্যতা ইলেকট্রনের সংখ্যা .
-
- গ্রুপ 1: ns¹ (1টি যোজ্যতা ইলেকট্রন). উদাহরণ: সোডিয়াম ([Ne] 3s¹).
-
- গ্রুপ 2: ns² (2টি যোজ্যতা ইলেকট্রন). উদাহরণ: ম্যাগনেসিয়াম ([Ne] 3s²).
-
- s-ব্লক মৌল: গ্রুপ নম্বর = বাইরের s-উপশেলে যোজ্যতা ইলেকট্রনের সংখ্যা .
-
- p-ব্লক মৌল: গ্রুপ নম্বর = (বাইরের s এবং p উপশেলে মোট ইলেকট্রনের সংখ্যা) + 10 .
-
- উদাহরণ: অ্যালুমিনিয়াম ([Ne] 3s² 3p¹) – যোজ্যতা ইলেকট্রন 2 + 1 = 3, গ্রুপ নম্বর 3 + 10 = 13.
-
- উদাহরণ: ক্লোরিন ([Ne] 3s² 3p⁵) – যোজ্যতা ইলেকট্রন 2 + 5 = 7, গ্রুপ নম্বর 7 + 10 = 17.
-
- p-ব্লক মৌল: গ্রুপ নম্বর = (বাইরের s এবং p উপশেলে মোট ইলেকট্রনের সংখ্যা) + 10 .
-
- d-ব্লক মৌল: গ্রুপ নম্বর = (n-1)d এবং ns উপশেলে ইলেকট্রনের সংখ্যার যোগফল .
-
- উদাহরণ: স্ক্যান্ডিয়াম ([Ar] 4s² 3d¹) – গ্রুপ নম্বর 1 + 2 = 3.
-
- উদাহরণ: আয়রন ([Ar] 4s² 3d⁶) – গ্রুপ নম্বর 6 + 2 = 8.
-
- ব্যতিক্রম: ক্রোমিয়াম ([Ar] 4s¹ 3d⁵) – গ্রুপ নম্বর 5 + 1 = 6.
-
- ব্যতিক্রম: কপার ([Ar] 4s¹ 3d¹⁰) – গ্রুপ নম্বর 10 + 1 = 11.
-
- d-ব্লক মৌল: গ্রুপ নম্বর = (n-1)d এবং ns উপশেলে ইলেকট্রনের সংখ্যার যোগফল .
-
- f-ব্লক মৌল: এরা সকলেই গ্রুপ 3 এর অন্তর্ভুক্ত.
উদাহরণ:
মৌল | ইলেকট্রন বিন্যাস | পর্যায় | ব্লক | গ্রুপ |
লিথিয়াম (Li) | 1s² 2s¹ | 2 | s | 1 |
ম্যাগনেসিয়াম (Mg) | [Ne] 3s² | 3 | s | 2 |
অ্যালুমিনিয়াম (Al) | [Ne] 3s² 3p¹ | 3 | p | 13 |
ক্লোরিন (Cl) | [Ne] 3s² 3p⁵ | 3 | p | 17 |
স্ক্যান্ডিয়াম (Sc) | [Ar] 4s² 3d¹ | 4 | d | 3 |
আয়রন (Fe) | [Ar] 4s² 3d⁶ | 4 | d | 8 |
কপার (Cu) | [Ar] 4s¹ 3d¹⁰ | 4 | d | 11 |
ব্রোমিন (Br) | [Ar] 4s² 3d¹⁰ 4p⁵ | 4 | p | 17 |
ক্রিপ্টন (Kr) | [Ar] 4s² 3d¹⁰ 4p⁶ | 4 | p | 18 |
পর্যায় সারণির মূল ভিত্তি হলো ইলেকট্রন বিন্যাস:
১. পর্যায় সারণিতে মৌলের অবস্থান নির্ধারণ:
-
- কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস থেকে সহজেই পর্যায় সারণিতে তার অবস্থান নির্ণয় করা যায়।
-
- ইলেকট্রন বিন্যাসের সবচেয়ে বাইরের প্রধান শক্তিস্তরের নম্বর মৌলটির পর্যায় সংখ্যা নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, লিথিয়ামের ইলেকট্রন বিন্যাস 1s22s1, এখানে বাইরের শক্তিস্তর ২, তাই লিথিয়াম ২য় পর্যায়ে অবস্থিত।
-
- গ্রুপ নম্বর বের করার নিয়ম বিভিন্ন। s-ব্লক মৌলের ক্ষেত্রে বাইরের শক্তিস্তরের ইলেকট্রন সংখ্যাই গ্রুপ নম্বর। p-ব্লক মৌলের ক্ষেত্রে বাইরের s ও p ইলেকট্রনের মোট সংখ্যার সাথে ১০ যোগ করলে গ্রুপ নম্বর পাওয়া যায়। d-ব্লক মৌলের ক্ষেত্রে বাইরের s ইলেকট্রন এবং তার আগের d ইলেকট্রনের যোগফল গ্রুপ নম্বর নির্দেশ করে।
২. মৌলসমূহের ধর্মের পূর্বাভাস:
-
- যে সকল মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাসের বাইরের প্রধান শক্তিস্তরের ইলেকট্রন সংখ্যা একই রকম, তাদের রাসায়নিক ধর্ম প্রায় একই ধরনের হয়। কারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মূলত বাইরের ইলেকট্রনগুলোই অংশগ্রহণ করে।
-
- উদাহরণস্বরূপ, গ্রুপ ১ এর সকল ক্ষার ধাতুর বাইরের স্তরে একটি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা সহজেই সেই ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আয়নে পরিণত হয়। ফলে এদের রাসায়নিক ধর্ম একই রকম হয়।
-
- আবার, গ্রুপ ১৭ এর হ্যালোজেনগুলোর বাইরের স্তরে ৭টি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হওয়ার প্রবণতা দেখায়।
৩. পর্যায় সারণির গঠন:
-
- পর্যায় সারণিতে মৌলগুলোকে পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। পারমাণবিক সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ইলেকট্রনগুলো বিভিন্ন শক্তিস্তরে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বিন্যস্ত হয়।
-
- যখন ইলেকট্রনগুলো আগের সব শেল পূর্ণ করে নতুন একটি শেলে প্রবেশ করে, তখন থেকেই একটি নতুন পর্যায় শুরু হয়।
-
- অন্যদিকে, একই গ্রুপের মৌলগুলোর ইলেকট্রন বিন্যাসের বহিঃস্থ স্তরের ইলেকট্রন কাঠামো একই রকম হওয়ার কারণে তাদের ধর্মও একই রকম হয় এবং তারা পর্যায় সারণির একই উল্লম্ব কলামে (গ্রুপে) স্থান পায়।
এজন্যই ইলেকট্রন বিন্যাসকে পর্যায় সারণির মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইলেকট্রন বিন্যাসের মাধ্যমেই মৌলদের পর্যায় সারণিতে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করা সম্ভব হয় এবং তাদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
পর্যায় সারনির কিছু ব্যতিক্রম
পর্যায় সারণি একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা হলেও, কিছু ক্ষেত্রে এর সাধারণ প্রবণতা থেকে ব্যতিক্রম দেখা যায়। এই ব্যতিক্রমগুলো ইলেকট্রন বিন্যাসের বিশেষ স্থিতিশীলতা এবং অন্যান্য পারমাণবিক কারণের জন্য ঘটে থাকে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রমের বিশদ বর্ণনা করা হলো:
১. ইলেকট্রন বিন্যাসের ব্যতিক্রম:
-
- কিছু মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস Aufbau নীতি অনুসরণ করে না। এর প্রধান কারণ হলো অর্ধপূর্ণ (half-filled) এবং সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ (fully-filled) ইলেকট্রন স্তরের অতিরিক্ত স্থিতিশীলতা।
-
- ক্রোমিয়াম (Cr) এবং কপার (Cu): ক্রোমিয়ামের ইলেকট্রন বিন্যাস হওয়ার কথা ছিল [Ar]3d44s2, কিন্তু বাস্তবে এটি [Ar]3d54s1 হয়। এর কারণ হলো 3d5 (অর্ধপূর্ণ) স্তর 3d4 স্তরের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল। একইভাবে, কপারের ইলেকট্রন বিন্যাস [Ar]3d94s2 হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে এটি [Ar]3d104s1 হয়, কারণ 3d10 (সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ) স্তর 3d9 স্তরের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল।
-
- এই একই ধরনের ব্যতিক্রম মলিবডেনাম (Mo), সিলভার (Ag) এবং গোল্ডের (Au) ক্ষেত্রেও দেখা যায়।
-
- কিছু মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস Aufbau নীতি অনুসরণ করে না। এর প্রধান কারণ হলো অর্ধপূর্ণ (half-filled) এবং সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ (fully-filled) ইলেকট্রন স্তরের অতিরিক্ত স্থিতিশীলতা।
২. আয়নীকরণ শক্তির ব্যতিক্রম:
-
- সাধারণত, একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে আয়নীকরণ শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়।
-
- বেরিলিয়াম (Be) এবং বোরন (B): বেরিলিয়ামের ইলেকট্রন বিন্যাস 1s22s2 এবং বোরনের 1s22s22p1. বেরিলিয়ামের সর্বশেষ ইলেকট্রনটি একটি পূর্ণ 2s অরবিটাল থেকে অপসারিত হয়, যা একটি স্থিতিশীল অবস্থা। অন্যদিকে, বোরনের সর্বশেষ ইলেকট্রনটি একটি অপেক্ষাকৃত কম স্থিতিশীল 2p অরবিটাল থেকে অপসারিত হয়। এই কারণে বোরনের প্রথম আয়নীকরণ শক্তি বেরিলিয়ামের চেয়ে কম।
-
- নাইট্রোজেন (N) এবং অক্সিজেন (O): নাইট্রোজেনের ইলেকট্রন বিন্যাস 1s22s22p3 (অর্ধপূর্ণ 2p অরবিটাল) এবং অক্সিজেনের 1s22s22p4. নাইট্রোজেনের অর্ধপূর্ণ 2p অরবিটালটি একটি স্থিতিশীল অবস্থা। অক্সিজেন যখন একটি ইলেকট্রন হারায়, তখন এটি একটি অর্ধপূর্ণ 2p অরবিটালে পৌঁছায়, যা তুলনামূলকভাবে বেশি স্থিতিশীল। এই কারণে অক্সিজেনের প্রথম আয়নীকরণ শক্তি নাইট্রোজেনের চেয়ে কম।
-
- সাধারণত, একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে আয়নীকরণ শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়।
৩. ইলেকট্রন আসক্তির ব্যতিক্রম:
-
- সাধারণত, একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে ইলেকট্রন আসক্তি বৃদ্ধি পায় (অধাতুদের ইলেকট্রন গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে)। তবে কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়।
-
- বেরিলিয়াম (Be) এবং নাইট্রোজেন (N): এদের স্থিতিশীল ইলেকট্রন বিন্যাসের কারণে (বেরিলিয়ামের পূর্ণ s অরবিটাল এবং নাইট্রোজেনের অর্ধপূর্ণ p অরবিটাল) এরা সহজে ইলেকট্রন গ্রহণ করতে চায় না। তাই এদের ইলেকট্রন আসক্তির মান প্রায় শূন্য বা ধনাত্মক হতে পারে, যা পর্যায়ের সাধারণ প্রবণতার বিপরীত।
-
- নোবেল গ্যাসসমূহ (Group 18): এদের বহিঃস্থ শক্তিস্তর সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ থাকায় এদের ইলেকট্রন গ্রহণের কোনো প্রবণতা নেই। তাই এদের ইলেকট্রন আসক্তির মান অত্যন্ত কম বা শূন্য।
-
- সাধারণত, একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে ইলেকট্রন আসক্তি বৃদ্ধি পায় (অধাতুদের ইলেকট্রন গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে)। তবে কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়।
৪. পারমাণবিক আকারের ব্যতিক্রম:
-
- সাধারণত, একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে পারমাণবিক আকার হ্রাস পায় এবং একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে গেলে বৃদ্ধি পায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়, বিশেষ করে অবস্থানান্তর মৌলগুলোর ক্ষেত্রে।
-
- ল্যান্থানাইড সংকোচন (Lanthanide Contraction): ল্যান্থানাইড সারির (Ce থেকে Lu) মৌলগুলোতে পারমাণবিক সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পারমাণবিক আকার প্রত্যাশার চেয়ে কম হ্রাস পায়। এর কারণ হলো 4f ইলেকট্রনগুলোর দুর্বল শিল্ডিং প্রভাব (screening effect)। এই কারণে পরবর্তী d-ব্লক মৌলগুলোর (যেমন Hf, Ta, W) আকার তাদের গ্রুপের উপরের মৌলগুলোর (Zr, Nb, Mo) আকারের প্রায় সমান হয়।
-
- সাধারণত, একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে পারমাণবিক আকার হ্রাস পায় এবং একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে গেলে বৃদ্ধি পায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়, বিশেষ করে অবস্থানান্তর মৌলগুলোর ক্ষেত্রে।
৫. অন্যান্য ধর্মের ব্যতিক্রম:
-
- এছাড়াও গলনাঙ্ক, স্ফুটনাঙ্ক, তড়িৎ ঋণাত্মকতা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়, যা ইলেকট্রন বিন্যাস, পারমাণবিক আকার এবং অন্যান্য পারমাণবিক কারণের জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফল।
এই ব্যতিক্রমগুলো পর্যায় সারণির সাধারণ প্রবণতা বুঝতে এবং মৌলদের রাসায়নিক আচরণ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রন বিন্যাসের স্থিতিশীলতা এবং পারমাণবিক গঠন এই ব্যতিক্রমগুলোর মূল কারণ।
মৌলের পর্যায়বৃত্ত ধর্ম বলতে পর্যায় সারণিতে মৌলগুলোকে তাদের পারমাণবিক সংখ্যা অনুসারে সাজালে যে ধর্মগুলো একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পরপর পুনরাবৃত্ত হয়, সেগুলোকে বোঝায়। এই ধর্মগুলো পর্যায় সারণির গ্রুপ (উল্লম্ব সারি) এবং পর্যায় (অনুভূমিক সারি) বরাবর একটি নির্দিষ্ট প্রবণতা দেখায়। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়বৃত্ত ধর্ম আলোচনা করা হলো:
মৌলের পর্যায়বৃত্ত ধর্ম:
১. পারমাণবিক ব্যাসার্ধ (Atomic Radius):

কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসের কেন্দ্র থেকে তার সর্ববহিঃস্থ ইলেকট্রন স্তরের গড় দূরত্বকে পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বলে।
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে পারমাণবিক ব্যাসার্ধ সাধারণত হ্রাস পায়। এর কারণ হলো, একই শক্তিস্তরে ইলেকট্রন সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জ বৃদ্ধি পায়, ফলে ইলেকট্রনগুলোর উপর আকর্ষণ বাড়ে এবং পরমাণুর আকার সংকুচিত হয়।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে পারমাণবিক ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো, প্রতিটি নতুন পর্যায়ে একটি করে নতুন ইলেকট্রন স্তর যুক্ত হয়, যা নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রনগুলোকে দূরে রাখে।
২. আয়োনিকরণ শক্তি (Ionization Energy):

গ্যাসীয় অবস্থায় কোনো মৌলের এক মোল বিচ্ছিন্ন পরমাণু থেকে একটি করে ইলেকট্রন অপসারণ করে এক মোল ধনাত্মক আয়নে পরিণত করতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়, তাকে আয়োনিকরণ শক্তি বলে।
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে আয়োনিকরণ শক্তি সাধারণত বৃদ্ধি পায়। কারণ পারমাণবিক আকার ছোট হওয়ার জন্য নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ বেশি থাকে এবং ইলেকট্রন অপসারণ করতে বেশি শক্তির প্রয়োজন হয়।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে আয়োনিকরণ শক্তি হ্রাস পায়। কারণ পারমাণবিক আকার বড় হওয়ার জন্য সর্ববহিঃস্থ ইলেকট্রনের উপর নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ কমে যায় এবং সহজেই ইলেকট্রন অপসারণ করা যায়।
৩. ইলেকট্রন আসক্তি (Electron Affinity):
গ্যাসীয় অবস্থায় কোনো মৌলের এক মোল পরমাণুতে একটি করে ইলেকট্রন যোগ করে এক মোল ঋণাত্মক আয়নে পরিণত করতে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তাকে ইলেকট্রন আসক্তি বলে।
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে ইলেকট্রন আসক্তি সাধারণত বৃদ্ধি পায়। কারণ পরমাণুর আকার ছোট হওয়ার জন্য নিউক্লিয়াসincoming ইলেকট্রনকে সহজে আকর্ষণ করতে পারে। তবে কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে ইলেকট্রন আসক্তি সাধারণত হ্রাস পায়। কারণ পরমাণুর আকার বড় হওয়ার জন্য নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ কমে যায় এবং ইলেকট্রন যোগ করলে কম শক্তি নির্গত হয়।
৪. তড়িৎ ঋণাত্মকতা (Electronegativity):
কোনো সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ দুটি পরমাণুর মধ্যে শেয়ার করা ইলেকট্রন যুগলকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার ক্ষমতাকে তড়িৎ ঋণাত্মকতা বলে।
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে তড়িৎ ঋণাত্মকতা বৃদ্ধি পায়। কারণ পারমাণবিক আকার ছোট এবং নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ বেশি থাকে।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে তড়িৎ ঋণাত্মকতা হ্রাস পায়। কারণ পারমাণবিক আকার বড় এবং নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ কম থাকে।
৫. ধাতব ধর্ম (Metallic Character):

মৌলের ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আয়ন গঠনের প্রবণতাকে ধাতব ধর্ম বলে।
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে ধাতব ধর্ম হ্রাস পায়। কারণ আয়োনিকরণ শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং ইলেকট্রন ত্যাগ করার প্রবণতা কমে।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে ধাতব ধর্ম বৃদ্ধি পায়। কারণ আয়োনিকরণ শক্তি হ্রাস পায় এবং ইলেকট্রন ত্যাগ করার প্রবণতা বাড়ে।
৬. অধাতব ধর্ম (Non-metallic Character):
মৌলের ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়ন গঠনের প্রবণতাকে অধাতব ধর্ম বলে।
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে অধাতব ধর্ম বৃদ্ধি পায়। কারণ ইলেকট্রন আসক্তি এবং তড়িৎ ঋণাত্মকতা বৃদ্ধি পায় এবং ইলেকট্রন গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে অধাতব ধর্ম হ্রাস পায়। কারণ ইলেকট্রন আসক্তি এবং তড়িৎ ঋণাত্মকতা হ্রাস পায় এবং ইলেকট্রন গ্রহণের প্রবণতা কমে।
৭.সক্রিয়তা (Reactivity):
মৌলের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের প্রবণতা বা ক্ষমতাকে সক্রিয়তা বলে। ধাতব এবং অধাতব উভয় মৌলের ক্ষেত্রেই সক্রিয়তার পর্যায়বৃত্ত ধর্ম ভিন্নভাবে দেখা যায়।
-
- ধাতুর সক্রিয়তা:
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে ধাতুর সক্রিয়তা সাধারণত হ্রাস পায়। এর কারণ হলো বাম থেকে ডানে পারমাণবিক আকার ছোট হয় এবং আয়োনিকরণ শক্তি বৃদ্ধি পায়, ফলে ইলেকট্রন ত্যাগ করার প্রবণতা কমে যায়। ক্ষার ধাতু (গ্রুপ ১) সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ধাতু।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে ধাতুর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো উপর থেকে নিচে পারমাণবিক আকার বড় হয় এবং আয়োনিকরণ শক্তি হ্রাস পায়, ফলে ইলেকট্রন ত্যাগ করার প্রবণতা বাড়ে।
-
- ধাতুর সক্রিয়তা:
-
- অধাতুর সক্রিয়তা:
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে অধাতুর সক্রিয়তা সাধারণত বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো বাম থেকে ডানে পারমাণবিক আকার ছোট হয় এবং ইলেকট্রন আসক্তি ও তড়িৎ ঋণাত্মকতা বৃদ্ধি পায়, ফলে ইলেকট্রন গ্রহণ করার প্রবণতা বাড়ে। হ্যালোজেন (গ্রুপ ১৭) সবচেয়ে বেশি সক্রিয় অধাতু।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে অধাতুর সক্রিয়তা সাধারণত হ্রাস পায়। এর কারণ হলো উপর থেকে নিচে পারমাণবিক আকার বড় হয় এবং ইলেকট্রন আসক্তি ও তড়িৎ ঋণাত্মকতা হ্রাস পায়, ফলে ইলেকট্রন গ্রহণ করার প্রবণতা কমে যায়।
-
- অধাতুর সক্রিয়তা:
৮. গলনাঙ্ক (Melting Point):

যে তাপমাত্রায় কোনো কঠিন পদার্থ তরলে পরিণত হয়, তাকে গলনাঙ্ক বলে।
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে গলনাঙ্কের তেমন কোনো সুস্পষ্ট এবং নিয়মিত প্রবণতা দেখা যায় না। সাধারণত, পর্যায়ের শুরুতে ধাতুদের গলনাঙ্ক প্রথমে বৃদ্ধি পায় (যেমন ক্ষার ধাতু থেকে শুরু করে গ্রুপ ৪ পর্যন্ত), এরপর মধ্যবর্তী মৌলগুলোর গলনাঙ্ক বেশ উচ্চ থাকে (যেমন संक्रमण ধাতু), এবং পরবর্তীতে অধাতুগুলোর দিকে গলনাঙ্ক দ্রুত হ্রাস পায়। এর কারণ হলো ধাতব বন্ধন, সমযোজী বন্ধন এবং ভ্যান ডার ওয়ালস বলের শক্তির পরিবর্তন।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের ক্ষেত্রে গলনাঙ্কের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট। সাধারণত, ধাতব গ্রুপের (যেমন ক্ষার ধাতু, মৃৎক্ষার ধাতু) উপর থেকে নিচে নামলে গলনাঙ্ক হ্রাস পায় (ধাতব বন্ধন দুর্বল হওয়ার কারণে)। অন্যদিকে, অধাতব গ্রুপের (যেমন হ্যালোজেন) উপর থেকে নিচে নামলে গলনাঙ্ক বৃদ্ধি পায় (আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল বৃদ্ধির কারণে)।
৯. স্ফুটনাঙ্ক (Boiling Point):

যে তাপমাত্রায় কোনো তরল পদার্থ গ্যাসে পরিণত হয়, তাকে স্ফুটনাঙ্ক বলে।
-
- পর্যায় বরাবর: গলনাঙ্কের মতোই স্ফুটনাঙ্কের ক্ষেত্রেও একই পর্যায়ে কোনো সুস্পষ্ট এবং নিয়মিত প্রবণতা দেখা যায় না। প্রথমে বৃদ্ধি, মাঝে উচ্চ এবং পরে হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বলের ভিন্নতার কারণে এই জটিলতা সৃষ্টি হয়।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের ক্ষেত্রে স্ফুটনাঙ্কের প্রবণতা গলনাঙ্কের মতোই অনেকটা একই রকম। ধাতব গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে স্ফুটনাঙ্ক সাধারণত হ্রাস পায় এবং অধাতব গ্রুপের উপর থেকে নিচে নামলে স্ফুটনাঙ্ক সাধারণত বৃদ্ধি পায়।
১০. যোজনী (Valency):
কোনো মৌলের একটি পরমাণু অন্য কোনো মৌলের পরমাণুর সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতাকে যোজনী বলে। এটি সাধারণত কোনো পরমাণুর সর্ববহিঃস্থ স্তরের ইলেকট্রন সংখ্যার উপর নির্ভর করে।
-
- পর্যায় বরাবর: একই পর্যায়ে বাম থেকে ডানে গেলে যোজনী প্রথমে ১ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় (যেমন গ্রুপ ১ এর ১, গ্রুপ ২ এর ২, গ্রুপ ১৩ এর ৩, গ্রুপ ১৪ এর ৪ পর্যন্ত)। এরপর এটি আবার হ্রাস পেতে শুরু করে (গ্রুপ ১৫ এর ৩, গ্রুপ ১৬ এর ২, গ্রুপ ১৭ এর ১) এবং নিষ্ক্রিয় গ্যাস (গ্রুপ ১৮) এর যোজনী সাধারণত শূন্য হয়। এর কারণ হলো সর্ববহিঃস্থ ইলেকট্রন স্তরে ইলেকট্রন সংখ্যা পরিবর্তনের সাথে সাথে বন্ধন গঠনের প্রবণতা পরিবর্তিত হয়।
-
- গ্রুপ বরাবর: একই গ্রুপের মৌলগুলোর সাধারণত একই রকম যোজনী প্রদর্শন করে। এর কারণ হলো একই গ্রুপের মৌলগুলোর সর্ববহিঃস্থ ইলেকট্রন স্তরে ইলেকট্রনের সংখ্যা একই থাকে। যেমন, গ্রুপ ১ এর সকল ক্ষার ধাতুর যোজনী ১, গ্রুপ ২ এর সকল মৃৎক্ষার ধাতুর যোজনী ২ এবং গ্রুপ ১৭ এর সকল হ্যালোজেনের যোজনী ১
বিভিন্ন গ্রুপে অবস্থিত মৌলগুলোর বিশেষ নাম:
গ্রুপ ১: ক্ষার ধাতু (Alkali Metals)
-
- এই গ্রুপের মৌলগুলো হলো: লিথিয়াম (Li), সোডিয়াম (Na), পটাসিয়াম (K), রুবিডিয়াম (Rb), সিজিয়াম (Cs), এবং ফ্র্যান্সিয়াম (Fr)।
-
- এদের সর্ববহিঃস্থ স্তরে ১ ইলেকট্রন থাকে এবং এরা সহজেই সেই ইলেকট্রন ত্যাগ করে +1 আয়ন গঠন করে।
-
- ক্ষার ধাতুগুলো খুবই সক্রিয় এবং নরম হয়, ছুরি দিয়েও কাটা যায়।
-
- এরা তীব্রভাবে পানির সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে এবং ক্ষারীয় দ্রবণ তৈরি করে।
গ্রুপ ২: মৃৎক্ষার ধাতু (Alkaline Earth Metals)
-
- এই গ্রুপের মৌলগুলো হলো: বেরিলিয়াম (Be), ম্যাগনেসিয়াম (Mg), ক্যালসিয়াম (Ca), স্ট্রনশিয়াম (Sr), বেরিয়াম (Ba), এবং রেডিয়াম (Ra)।
-
- এদের সর্ববহিঃস্থ স্তরে দুটি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা সহজেই সেই ইলেকট্রন ত্যাগ করে +2 আয়ন গঠন করে।
-
- মৃৎক্ষার ধাতুগুলো ক্ষার ধাতুর তুলনায় কম সক্রিয় এবং এদের ঘনত্ব ও গলনাঙ্ক বেশি।
গ্রুপ ৩ থেকে গ্রুপ ১২: অবস্থানান্তর ধাতু (Transition Metals)

-
- এই গ্রুপের মধ্যে অনেক পরিচিত ধাতু যেমন লোহা (Fe), তামা (Cu), সোনা (Au), রূপা (Ag) ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
-
- এরা পরিবর্তনশীল যোজ্যতা প্রদর্শন করে এবং রঙিন যৌগ গঠন করে।
-
- এদের উচ্চ গলনাঙ্ক এবং স্ফুটনাঙ্ক থাকে এবং এরা ভালো তড়িৎ পরিবাহী।
-
- এরা প্রায়শই অনুঘটক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
গ্রুপ ১৩: বোরন গ্রুপ (Boron Group) বা ত্রয়ী মৌল (Triels)
-
- এই গ্রুপের প্রথম মৌল হলো বোরন (B), যা একটি অপধাতু। বাকি মৌলগুলো হলো অ্যালুমিনিয়াম (Al), গ্যালিয়াম (Ga), ইন্ডিয়াম (In), এবং থ্যালিয়াম (Tl)।
-
- এদের সর্ববহিঃস্থ স্তরে তিনটি ইলেকট্রন থাকে।
-
- এই গ্রুপের মৌলগুলোর মধ্যে ধাতব এবং অধাতব উভয় বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
গ্রুপ ১৪: কার্বন গ্রুপ (Carbon Group) বা টেট্রেলস (Tetrels)
-
- এই গ্রুপের প্রথম মৌল হলো কার্বন (C), যা একটি অধাতু। বাকি মৌলগুলো হলো সিলিকন (Si), জার্মেনিয়াম (Ge) (উভয়ই অপধাতু), টিন (Sn), এবং লেড (Pb) (উভয়ই ধাতু)।
-
- এদের সর্ববহিঃস্থ স্তরে চারটি ইলেকট্রন থাকে।
-
- এই গ্রুপে অধাতু, অপধাতু এবং ধাতু – তিন ধরনের মৌলই বিদ্যমান।
গ্রুপ ১৫: নাইট্রোজেন গ্রুপ (Nitrogen Group) বা পেন্টেলস (Pnictogens)
-
- এই গ্রুপের মৌলগুলো হলো: নাইট্রোজেন (N), ফসফরাস (P) (উভয়ই অধাতু), আর্সেনিক (As), অ্যান্টিমনি (Sb) (উভয়ই অপধাতু), এবং বিসমাথ (Bi) (ধাতু)।
-
- এদের সর্ববহিঃস্থ স্তরে পাঁচটি ইলেকট্রন থাকে।
গ্রুপ ১৬: অক্সিজেন গ্রুপ (Oxygen Group) বা চ্যালকোজেন (Chalcogens)
-
- এই গ্রুপের মৌলগুলো হলো: অক্সিজেন (O), সালফার (S), সেলেনিয়াম (Se) (অধাতু), টেলুরিয়াম (Te) (অপধাতু), এবং পোলোনিয়াম (Po) (ধাতু)।
-
- এদের সর্ববহিঃস্থ স্তরে ছয়টি ইলেকট্রন থাকে।
-
- এই গ্রুপের মৌলগুলো সাধারণত -2 আয়ন গঠন করে।
গ্রুপ ১৭: হ্যালোজেন (Halogens)

-
- এই গ্রুপের মৌলগুলো হলো: ফ্লুরিন (F), ক্লোরিন (Cl), ব্রোমিন (Br), আয়োডিন (I), অ্যাস্টাটিন (At), এবং টেনেসিন (Ts)।
-
- এদের সর্ববহিঃস্থ স্তরে সাতটি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা সহজেই একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে -1 আয়ন গঠন করে।
-
- হ্যালোজেনগুলো খুবই সক্রিয় অধাতু এবং লবণ উৎপাদক হিসেবে পরিচিত (গ্রিক শব্দ ” halos” অর্থ লবণ এবং “gen” অর্থ উৎপাদনকারী)।
গ্রুপ ১৮: নিষ্ক্রিয় গ্যাস (Noble Gases) বা বিরল গ্যাস (Rare Gases)
-
- এই গ্রুপের মৌলগুলো হলো: হিলিয়াম (He), নিয়ন (Ne), আর্গন (Ar), ক্রিপ্টন (Kr), জেনন (Xe), রেডন (Rn), এবং ওগানেসন (Og)।
-
- এদের সর্ববহিঃস্থ ইলেকট্রন স্তর সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ থাকে (হিলিয়ামের ক্ষেত্রে দুটি এবং বাকিদের ক্ষেত্রে আটটি ইলেকট্রন)।
-
- এই কারণে এরা সাধারণত রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকে এবং সহজে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না।
এছাড়াও, পর্যায় সারণির নিচে দুটি আলাদা সারি রয়েছে যাদেরকে একত্রে অন্তঃস্থ অবস্থানান্তর ধাতু (Inner Transition Metals) বলা হয়। এদের আবার দুটি অংশে ভাগ করা হয়:
-
- ল্যান্থানাইড সারি (Lanthanide Series): ল্যান্থানাম (La) এর পরে সিরিয়াম (Ce) থেকে লুটেটিয়াম (Lu) পর্যন্ত ১৪টি মৌল এই সারিতে অবস্থিত। এদের বৈশিষ্ট্য ল্যান্থানামের মতো।
-
- অ্যাক্টিনাইড সারি (Actinide Series): অ্যাক্টিনিয়াম (Ac) এর পরে থোরিয়াম (Th) থেকে লরেন্সিয়াম (Lr) পর্যন্ত ১৪টি মৌল এই সারিতে অবস্থিত। এদের বেশিরভাগই তেজস্ক্রিয় এবং এদের বৈশিষ্ট্য অ্যাক্টিনিয়ামের মতো।
পর্যায় সারনির সুবিধা:
পর্যায় সারণি রসায়ন বিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি মৌল এবং তাদের যৌগসমূহ সম্পর্কে ধারণা লাভ এবং বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া অনুধাবন করতে অপরিহার্য।
১. মৌলদের শ্রেণিবিন্যাস ও সংগঠন:
-
- পর্যায় সারণি বিভিন্ন ধর্ম অনুসারে মৌলগুলোকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়েছে। পারমাণবিক সংখ্যা বৃদ্ধির ক্রমানুসারে মৌলগুলোকে সারি (পর্যায়) এবং স্তম্ভে (গ্রুপ) বিন্যস্ত করার ফলে একই গ্রুপের মৌলগুলো একই ধরনের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।
-
- এই শ্রেণিবিন্যাস রসায়ন অধ্যয়নকে অনেক সহজ করে তোলে। অসংখ্য মৌলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মনে রাখার পরিবর্তে, নির্দিষ্ট গ্রুপের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করলেই সেই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য মৌল সম্পর্কেও একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়।
২. মৌলদের ধর্ম সম্পর্কে পূর্বাভাস:
-
- পর্যায় সারণির অবস্থান দেখে কোনো মৌলের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। যেমন – ধাতব ধর্ম, অধাতব ধর্ম, তড়িৎ ঋণাত্মকতা, আয়োনিকরণ শক্তি, পারমাণবিক আকার ইত্যাদি ধর্মের পর্যায়ভিত্তিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে যেকোনো অজানা মৌলের ধর্ম সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব।
-
- কোনো গ্রুপের একটি বা দুটি পরিচিত মৌলের ধর্ম জানা থাকলে সেই গ্রুপের অন্যান্য মৌলের ধর্ম সম্পর্কেও অনুমান করা যায়।
৩. নতুন মৌল আবিষ্কারে সহায়ক:
-
- পর্যায় সারণিতে কিছু ফাঁকা স্থান ছিল যা পরবর্তীতে নতুন মৌল আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীদের দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। মেন্ডেলিফ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে সেই ফাঁকা স্থানগুলোতে এমন কিছু মৌল থাকবে যাদের বৈশিষ্ট্য তিনি ইতোমধ্যে পরিচিত মৌলদের ধর্মের ওপর ভিত্তি করে অনুমান করেছিলেন। পরবর্তীতে গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম এবং স্ক্যান্ডিয়ামের আবিষ্কার তার ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য প্রমাণ করে।
৪. রাসায়নিক বিক্রিয়া অনুধাবনে সাহায্য:
-
- পর্যায় সারণি মৌলদের ইলেকট্রন বিন্যাস এবং যোজ্যতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। এর মাধ্যমে কোন মৌল কীভাবে রাসায়নিক বন্ধন গঠন করবে এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে তা সহজেই বোঝা যায়।
-
- কোন দুটি মৌলের মধ্যে বিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং উৎপন্ন যৌগগুলোর বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, সে সম্পর্কেও পর্যায় সারণির জ্ঞান সহায়ক।
৫. রসায়ন শিক্ষাকে সহজ করে:
-
- পর্যায় সারণি রসায়নের জটিল ধারণাগুলোকে সহজে উপস্থাপন করে। ছাত্রছাত্রীরা মৌল এবং তাদের ধর্ম সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা লাভ করতে পারে।
-
- এটি বিভিন্ন রাসায়নিক ধারণা যেমন – পরমাণুর গঠন, রাসায়নিক বন্ধন, জারণ-বিজারণ ইত্যাদি বুঝতে সাহায্য করে।
৬. গবেষণায় অপরিহার্য:
-
- রসায়ন এবং রসায়ন সম্পর্কিত অন্যান্য গবেষণা ক্ষেত্রে পর্যায় সারণি একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নতুন যৌগ তৈরি, পদার্থের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া অপটিমাইজ করার ক্ষেত্রে পর্যায় সারণির জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পর্যায় সারনির একই গ্রুপের মৌল গুলো দ্বারা গঠিত যৌগের বিক্রিয়া:
গ্রুপ ১: ক্ষার ধাতু (Alkali Metals)
ক্ষার ধাতুগুলো অত্যন্ত সক্রিয় এবং সহজেই ইলেকট্রন ত্যাগ করে +1 আয়ন গঠন করে। এদের কিছু সাধারণ বিক্রিয়া হলো:
পানির সাথে বিক্রিয়া: ক্ষার ধাতুগুলো পানির সাথে তীব্রভাবে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন গ্যাস (H2) এবং ধাতব হাইড্রোক্সাইড (MOH) উৎপন্ন করে। গ্রুপের নিচের দিকে সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, তাই লিথিয়ামের বিক্রিয়া ধীরে হলেও সোডিয়াম, পটাসিয়াম এবং অন্যান্য ভারী ক্ষার ধাতু বিস্ফোরকভাবে বিক্রিয়া করে।
2M(s )+2H2O(l) → 2MOH(aq) + H2(g)
(এখানে M = Li, Na, K, Rb, Cs)
গ্রুপ ২: মৃৎক্ষার ধাতু (Alkaline Earth Metals)
মৃৎক্ষার ধাতুগুলো ক্ষার ধাতুর তুলনায় কম সক্রিয় এবং +2 আয়ন গঠন করে। এদের কিছু সাধারণ বিক্রিয়া হলো:
- পানির সাথে বিক্রিয়া: মৃৎক্ষার ধাতুগুলোও পানির সাথে বিক্রিয়া করে ধাতব হাইড্রোক্সাইড (M(OH)2) এবং হাইড্রোজেন গ্যাস ( H2) উৎপন্ন করে। তবে এদের সক্রিয়তা ক্ষার ধাতুর তুলনায় কম। বেরিলিয়াম (Be) প্রায় বিক্রিয়া করে না, ম্যাগনেসিয়াম (Mg) গরম পানির সাথে ধীরে ধীরে বিক্রিয়া করে, এবং ক্যালসিয়াম (Ca), স্ট্রনশিয়াম (Sr) ও বেরিয়াম (Ba) দ্রুত বিক্রিয়া করে।
M(s) + 2 H2O(l) → M(OH)2(aq) + H2(g)
(এখানে M = Ca, Sr, Ba) - হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া: মৃৎক্ষার ধাতুগুলো হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ধাতব হ্যালাইড (MX2) গঠন করে।
M(s) +X2(g) → MX2(s)
(এখানে M = Be, Mg, Ca, Sr, Ba এবং X = F, Cl, Br, I) - অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া: মৃৎক্ষার ধাতুগুলো অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ধাতব অক্সাইড (MO) গঠন করে।
2M(s) + O2O2(g) → 2MO(s)
(এখানে M = Be, Mg, Ca, Sr, Ba)
সংক্রমণ ধাতু (Group 3-12)
সংক্রমণ ধাতুগুলো পরিবর্তনশীল যোজ্যতা প্রদর্শন করে এবং জটিল যৌগ গঠন করে। এদের বিক্রিয়াগুলো বেশ জটিল এবং বিভিন্ন প্রভাবকের উপর নির্ভরশীল। কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো:
- অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া: এরা বিভিন্ন ধরনের অক্সাইড গঠন করে, যেখানে ধাতুর জারণ অবস্থা ভিন্ন হতে পারে (যেমন লোহা FeO,Fe2O3 ,Fe3O4 গঠন করে)।
- হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া: এরা বিভিন্ন ধাতব হ্যালাইড গঠন করে (যেমন কপার CuCl, CuCl2গঠন করে)।
- জটিল যৌগ গঠন: এদের d-অরবিটাল ফাঁকা থাকায় এরা লিগ্যান্ডের সাথে সমন্বিত হয়ে জটিল যৌগ গঠন করে।
গ্রুপ ১৩: বোরন গ্রুপ (Boron Group)
এই গ্রুপের মৌলগুলোর সর্ববহিঃস্থ স্তরে ৩টি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা সাধারণত +3 জারণ অবস্থা প্রদর্শন করে। বোরন (B) অধাতু হলেও বাকি মৌলগুলো (Al, Ga, In, Tl) ধাতু।
- অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে অক্সাইড (M2O3) গঠন করে।
M2 +3O3(g) →2M2O3(s)
(এখানে M = Al, Ga, In, Tl)
বোরনও অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে বোরন ট্রাইঅক্সাইড (B2O3) গঠন করে। অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (Al2O3 ) একটি উভধর্মী অক্সাইড। - হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ট্রাইহ্যালাইড (MX3) গঠন করে।
2M(s) + 3X2(g) → 2MX3(s)
(এখানে M = B, Al, Ga, In, Tl এবং X = F, Cl, Br, I)
বোরন ট্রাইফ্লুরাইড (BF3) একটি লুইস অ্যাসিড হিসেবে কাজ করে। অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড (AlCl3) আর্দ্র অবস্থায় দ্বিমারক (Al2Cl6) হিসেবে থাকে। - অ্যাসিডের সাথে বিক্রিয়া: অ্যালুমিনিয়াম, গ্যালিয়াম, ইন্ডিয়াম এবং থ্যালিয়াম অ্যাসিডের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে।
2Al(s) + 6HCl(aq) → 2AlCl3(aq) + 3 H2(g) - ক্ষারকের সাথে বিক্রিয়া: অ্যালুমিনিয়াম এবং গ্যালিয়াম ক্ষারকের সাথেও বিক্রিয়া করে জটিল লবণ এবং হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে।
2Al(s) + 2NaOH(aq) + 6 H2O(l) → 2Na[Al (OH)4](aq) + 3 H2(g) - হাইড্রাইডের সাথে বিক্রিয়া: বোরন হাইড্রাইড (B2H6, ডিবোরেন) একটি গুরুত্বপূর্ণ যৌগ যা বিভিন্ন জৈব সংশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়। অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রাইড ((AlH3)n) একটি পলিমারিক যৌগ।
গ্রুপ ১৪: কার্বন গ্রুপ (Carbon Group)এই গ্রুপের মৌলগুলোর সর্ববহিঃস্থ স্তরে ৪টি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা সাধারণত +4, +2 এবং -4 জারণ অবস্থা প্রদর্শন করে। এই গ্রুপে অধাতু (C), অপধাতু (Si, Ge) এবং ধাতু (Sn, Pb) উভয়ই রয়েছে।
- অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ডাইঅক্সাইড (EO2) এবং মনোক্সাইড (EO) গঠন করে (কার্বন CO,CO2; সিলিকন SiO2; জার্মেনিয়াম GeO2O2; টিন SnO,SnO2 লেড PbO,PbO2)। কার্বন ডাইঅক্সাইড একটি অম্লীয় অক্সাইড এবং সিলিকন ডাইঅক্সাইড একটি নেটওয়ার্ক কঠিন পদার্থ।
C(s) + O2(g)→ C O2(g)
Si(s) + O2(g) → Si O2(s) - হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো টেট্রাহ্যালাইড (EX4) গঠন করে। কার্বন টেট্রাক্লোরাইড (CCl4) একটি পরিচিত যৌগ। টিন এবং লেড ডাইহ্যালাইড (SnX2,PbX2) ও গঠন করে।
C(s) + 2Cl2(g) → CCl4(l)
Sn(s) + 2Cl2(g) → SnCl4(l) - হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া: কার্বন হাইড্রোজেনের সাথে অসংখ্য যৌগ গঠন করে যা জৈব রসায়নের মূল ভিত্তি (যেমন মিথেনCH4, ইথেন C2H6 ইত্যাদি)। সিলিকনও হাইড্রোজেনের সাথে সিলেন (SiH4,Si2H6) গঠন করে। টিন হাইড্রাইড (SnH4) এবং লেড হাইড্রাইড (PbH4) অস্থির যৌগ।
- অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ডাইঅক্সাইড (EO2) এবং মনোক্সাইড (EO) গঠন করে (কার্বন CO,CO2; সিলিকন SiO2; জার্মেনিয়াম GeO2O2; টিন SnO,SnO2 লেড PbO,PbO2)। কার্বন ডাইঅক্সাইড একটি অম্লীয় অক্সাইড এবং সিলিকন ডাইঅক্সাইড একটি নেটওয়ার্ক কঠিন পদার্থ।
গ্রুপ ১৫: নাইট্রোজেন গ্রুপ (Pnictogens)
এই গ্রুপের মৌলগুলোর সর্ববহিঃস্থ স্তরে ৫টি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা সাধারণত -3, +3 বা +5 যোজ্যতা প্রদর্শন করে।
- হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রাইড (EH3) গঠন করে।
2E(g) + 3H3(g)→ 2EH4(g)
(এখানে E = N, P, As, Sb, Bi) - অ্যামোনিয়া (NH3) একটি সুপরিচিত যৌগ। গ্রুপের নিচের দিকে হাইড্রাইডের স্থায়িত্ব হ্রাস পায়।
- অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো বিভিন্ন ধরনের অক্সাইড গঠন করে, যেমন –E2O3 এবংE2O5. নাইট্রোজেনের (N2O,NO,N2O3 ,NO2,N2O5) অনেক অক্সাইড রয়েছে। ফসফরাস (P4O6,P4O10), আর্সেনিক (As2O3,As2O5), অ্যান্টিমনি (Sb2O3,Sb2O5) এবং বিসমাথ (Bi2O3) ও অক্সাইড গঠন করে। অক্সাইডের অম্লীয় ধর্ম গ্রুপের নিচের দিকে হ্রাস পায় (যেমনN2 O5অম্লীয়,Bi2O3 ক্ষারীয়)।
হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো ট্রাইহ্যালাইড (EX3) এবং পেন্টাহ্যালাইড (EX5) গঠন করতে পারে (নাইট্রোজেন NX5 গঠন করে না)।
P4(s) + 6Cl2(g) → 4PCl3(l)
P4P4(s) + 10Cl2(g) → 4PCl5(s)
গ্রুপ ১৬: অক্সিজেন গ্রুপ (Chalcogens)
এই গ্রুপের মৌলগুলোর সর্ববহিঃস্থ স্তরে ৬টি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা সাধারণত -2, +2, +4 বা +6 যোজ্যতা প্রদর্শন করে।
- হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রাইড (H2E) গঠন করে।
H2(g) +E(g) → H2E(g)
(এখানে E = O, S, Se, Te, Po)
পানি (H2O) একটি অতি পরিচিত যৌগ। গ্রুপের নিচের দিকে হাইড্রাইডের অম্লীয় ধর্ম বৃদ্ধি পায় এবং স্থায়িত্ব হ্রাস পায়। - অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া: অক্সিজেন নিজে এই গ্রুপের মৌল, তাই অন্যান্য মৌলগুলো অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ডাইঅক্সাইড (EO2) এবং ট্রাইঅক্সাইড (EO3) গঠন করে (সালফার SO2,SO3; সেলেনিয়াম SeO2,SeO3; টেলুরিয়াম TeO2,TeO3)।
- হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো বিভিন্ন ধরনের হ্যালাইড গঠন করে, যেমন – ডাইহ্যালাইড (EX2), টেট্রাহ্যালাইড (EX4) এবং হেক্সাহ্যালাইড (EX6)। সালফার (SF6) একটি পরিচিত উদাহরণ।
গ্রুপ ১৭: হ্যালোজেন (Halogens)
হ্যালোজেনগুলো অত্যন্ত সক্রিয় অধাতু এবং সহজেই একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে -1 আয়ন গঠন করে। এদের কিছু সাধারণ বিক্রিয়া হলো:
- ধাতুর সাথে বিক্রিয়া: হ্যালোজেনগুলো ধাতুর সাথে বিক্রিয়া করে ধাতব হ্যালাইড (MXn) গঠন করে। বিক্রিয়ার তীব্রতা হ্যালোজেনের সক্রিয়তার উপর নির্ভর করে (ফ্লুরিন সবচেয়ে বেশি এবং আয়োডিন সবচেয়ে কম সক্রিয়)।
2Na(s) + Cl2(g)→2NaCl(s) - হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া: হ্যালোজেনগুলো হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন হ্যালাইড (HX) গ্যাস উৎপন্ন করে। ফ্লুরিন বিস্ফোরকভাবে, ক্লোরিন সূর্যালোকের উপস্থিতিতে, ব্রোমিন উত্তপ্ত অবস্থায় এবং আয়োডিন অনুঘটকের উপস্থিতিতে বিক্রিয়া করে।
H2(g) +X2(g) → 2HX(g) - অন্যান্য হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া: একটি হ্যালোজেন তার নিচের হ্যালোজেনকে তাদের লবণ দ্রবণ থেকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে (যেমন ক্লোরিন ব্রোমাইড দ্রবণ থেকে ব্রোমিনকে প্রতিস্থাপিত করে)।
Cl2(g) + 2KBr(aq) → 2KCl(aq) + Br2(l)
গ্রুপ ১৮: নিষ্ক্রিয় গ্যাস (Noble Gases)
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর সর্ববহিঃস্থ ইলেকট্রন স্তর পূর্ণ থাকায় এরা সাধারণত রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকে এবং সহজে কোনো বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। তবে, কিছু ভারী নিষ্ক্রিয় গ্যাস (যেমন জেনন এবং ক্রিপ্টন) বিশেষ পরিস্থিতিতে ফ্লুরিন এবং অক্সিজেনের সাথে যৌগ গঠন করতে পারে।
গ্রুপ ১৬: অক্সিজেন গ্রুপ (Chalcogens)
এই গ্রুপের মৌলগুলোর সর্ববহিঃস্থ স্তরে ৬টি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা সাধারণত -2, +2, +4 বা +6 যোজ্যতা প্রদর্শন করে।
- হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রাইড (H2E) গঠন করে।
H2(g) +E(g) → H2E(g)
(এখানে E = O, S, Se, Te, Po)
পানি (H2O) একটি অতি পরিচিত যৌগ। গ্রুপের নিচের দিকে হাইড্রাইডের অম্লীয় ধর্ম বৃদ্ধি পায় এবং স্থায়িত্ব হ্রাস পায়। - অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া: অক্সিজেন নিজে এই গ্রুপের মৌল, তাই অন্যান্য মৌলগুলো অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ডাইঅক্সাইড (EO2) এবং ট্রাইঅক্সাইড (EO3) গঠন করে (সালফার SO2,SO3; সেলেনিয়াম SeO2,SeO3; টেলুরিয়াম TeO2,TeO3)।
- হ্যালোজেনের সাথে বিক্রিয়া: এই গ্রুপের মৌলগুলো বিভিন্ন ধরনের হ্যালাইড গঠন করে, যেমন – ডাইহ্যালাইড (EX2), টেট্রাহ্যালাইড (EX4) এবং হেক্সাহ্যালাইড (EX6)। সালফার (SF6) একটি পরিচিত উদাহরণ।
গ্রুপ ১৭: হ্যালোজেন (Halogens)
হ্যালোজেনগুলো অত্যন্ত সক্রিয় অধাতু এবং সহজেই একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে -1 আয়ন গঠন করে। এদের কিছু সাধারণ বিক্রিয়া হলো:
- ধাতুর সাথে বিক্রিয়া: হ্যালোজেনগুলো ধাতুর সাথে বিক্রিয়া করে ধাতব হ্যালাইড (MXn) গঠন করে। বিক্রিয়ার তীব্রতা হ্যালোজেনের সক্রিয়তার উপর নির্ভর করে (ফ্লুরিন সবচেয়ে বেশি এবং আয়োডিন সবচেয়ে কম সক্রিয়)।
2Na(s) + Cl2(g)→2NaCl(s) - হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া: হ্যালোজেনগুলো হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন হ্যালাইড (HX) গ্যাস উৎপন্ন করে। ফ্লুরিন বিস্ফোরকভাবে, ক্লোরিন সূর্যালোকের উপস্থিতিতে, ব্রোমিন উত্তপ্ত অবস্থায় এবং আয়োডিন অনুঘটকের উপস্থিতিতে বিক্রিয়া করে।
H2(g) +X2(g) → 2HX(g)
