পদার্থের গঠন সম্পর্কিত ডেমোক্রিটাসের চিন্তাধারা (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০)
অনেক আগে, প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক ডেমোক্রিটাস একটি মজার ও বৈপ্লবিক ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি তুমি কোনো বস্তুকে বারবার টুকরো করো, এক সময় এমন একটি ক্ষুদ্রতম অংশ পাবে, যাকে আর ভাগ করা যাবে না। তিনি একে নাম দেন “অ্যাটমস” (atomos) — যার অর্থ “অবিভাজ্য” বা “যাকে আর ভাগ করা যায় না”।
মজার বিষয় হলো, ডেমোক্রিটাসের এই চিন্তা ছিল পুরোপুরি কল্পনার ভিত্তিতে — তিনি কোনো পরীক্ষাগার ব্যবহার করেননি! বিজ্ঞান তখনও এতটা উন্নত ছিল না, তাই তার এই ধারণা প্রায় ২০০০ বছর ধরে গুরুত্ব পায়নি।

ডালটনের পুনরাবিষ্কার (১৮০৩)
১৮০৩ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডালটন আবার পরমাণুর ধারণাকে বৈজ্ঞানিকভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক মৌল একটি নির্দিষ্ট ধরনের পরমাণু দ্বারা গঠিত। ডালটনের কাজ থেকেই আধুনিক রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার ভিত্তি তৈরি হয়।
এই ঘটনাগুলো দেখায়, মানুষ কত প্রাচীনকাল থেকে জিজ্ঞাসা করে এসেছে — “পদার্থ আসলে কী দিয়ে তৈরি?” আর আজ আমরা জানি, সেই “অদৃশ্য কণা”র ভেতরেও আরও অনেক কিছু লুকিয়ে আছে — যেমন প্রোটন, ইলেকট্রন, কোয়ার্ক
ডালটনের পরমাণু মডেলের মূল ধারণাগুলো:
- সমস্ত পদার্থ গঠিত অতি ক্ষুদ্র কণা পরমাণু দিয়ে।
- পরমাণু খুবই ছোট, অবিভাজ্য এবং অপরিবর্তনীয়।
- একই মৌলের সব পরমাণু একইরকম – আকার, ভর ও ধর্মে অভিন্ন।
- ভিন্ন মৌলের পরমাণুগুলোর মধ্যে ভিন্নতা থাকে – আকার, ভর ও ধর্ম আলাদা।
- রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণু ধ্বংস বা সৃষ্টি হয় না, কেবল পুনঃবিন্যাস হয়।
- যৌগ গঠিত হয় পরমাণুর নির্দিষ্ট সংখ্যা ও অনুপাতে মিলনে।
- একটি নির্দিষ্ট যৌগে সবসময় একই অনুপাতে পরমাণু থাকে – যেমন H₂O তে সবসময় ২টি হাইড্রোজেন ও ১টি অক্সিজেন থাকে।
ডালটনের পরমাণু মডেলের সীমাবদ্ধতা:
- ডালটন পরমাণুকে অবিভাজ্য (indivisible) বলেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে পরমাণু বিভাজ্য।
- তিনি ধারণা করেছিলেন, একই মৌলের সব পরমাণুর ভর এক, কিন্তু আইসোটোপ আবিষ্কারে জানা যায়, একই মৌলের পরমাণুর ভর ভিন্ন হতে পারে।
- পরমাণুর অভ্যন্তরীণ গঠন (যেমন, ইলেকট্রন, নিউক্লিয়াস) সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না।
- পরমাণুর আকৃতি ও বিন্যাস কেমন, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
- রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ইলেকট্রনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করা হয়নি।
- আলোক বিকিরণ, স্পেকট্রাম ও বন্ড গঠন সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা নেই।
মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ
মৌলিক পদার্থ কী?
যেসব পদার্থ কেবল এক ধরনের পরমাণু দিয়ে গঠিত এবং রাসায়নিকভাবে আর ভাঙা যায় না, তাদের মৌলিক পদার্থ বলা হয়।
উদাহরণ:
- হাইড্রোজেন (H)
- অক্সিজেন (O)
- লোহা (Fe)
- কার্বন (C)
বৈশিষ্ট্য:
- কেবল এক ধরনের পরমাণু থাকে।
- রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভাঙা যায় না।
- প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উভয় ধরণের মৌলিক পদার্থ রয়েছে।
- মৌলিক পদার্থের সংখ্যা বর্তমানে ১১৮টি।
যৌগিক পদার্থ কী?
যেসব পদার্থ দুই বা ততোধিক ভিন্ন মৌলিক পদার্থ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে তৈরি হয়, তাদের যৌগিক পদার্থ বলে।
উদাহরণ:
- পানি (H₂O) → হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দিয়ে গঠিত
- লবণ (NaCl) → সোডিয়াম ও ক্লোরিন দিয়ে গঠিত
- কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) → কার্বন ও অক্সিজেন দিয়ে গঠিত
বৈশিষ্ট্য:
- দুই বা ততোধিক ভিন্ন ধরনের পরমাণু থাকে।
- রাসায়নিক বিক্রিয়ায় গঠিত হয়।
- বিশ্লেষণ করলে মৌলিক পদার্থে ভেঙে যায়।
মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের পার্থক্য:
বিষয় | মৌলিক পদার্থ | যৌগিক পদার্থ |
সংজ্ঞা |
যেসব পদার্থ কেবল এক ধরনের পরমাণু দিয়ে গঠিত এবং তাদের মৌলিক পদার্থ বলা হয়।রাসায়নিকভাবে আর ভাঙা যায় না | যেসব পদার্থ দুই বা ততোধিক ভিন্ন মৌলিক পদার্থ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে তৈরি হয়, তাদের যৌগিক পদার্থ বলে। |
গঠন | এক ধরনের পরমাণু | একাধিক ভিন্ন ধরনের পরমাণু |
বিশ্লেষণযোগ্যতা | রাসায়নিকভাবে ভাঙা যায় না | রাসায়নিকভাবে মৌলে ভেঙে যায় |
উদাহরণ | হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, লোহা | পানি, লবণ, কার্বন ডাই-অক্সাইড |
অণু এবং পরমাণু
পরমাণু (Atom) কী?
পরমাণু হলো পদার্থের সবচেয়ে ছোট কণা, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। এটি এত ছোট যে খালি চোখে দেখা যায় না।

বৈশিষ্ট্য:
- এটি পদার্থের মৌলিক একক।
- প্রতিটি মৌলের একটি নির্দিষ্ট পরমাণু থাকে।
- পরমাণুর প্রধান তিনটি অংশ হলো:
- ইলেকট্রন (ঋণাত্মক চার্জযুক্ত)
- প্রোটন (ধনাত্মক চার্জযুক্ত)
- নিউট্রন (নিরপেক্ষ)
উদাহরণ:
- হাইড্রোজেন পরমাণু (H)
- অক্সিজেন পরমাণু (O)
অণু (Molecule) কী?
অণু হলো দুই বা ততোধিক পরমাণু একসাথে যুক্ত হয়ে যে কণা তৈরি করে, তাকে অণু বলে। এটি পদার্থের স্বাধীন অস্তিত্বসম্পন্ন একক।

বৈশিষ্ট্য:
- একই বা ভিন্ন পরমাণু দিয়ে গঠিত হয়।
- রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে তৈরি হয়।
- এটি পদার্থের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে।
উদাহরণ:
- পানি (H₂O) → ২টি হাইড্রোজেন + ১টি অক্সিজেন
- অক্সিজেন গ্যাস (O₂) → ২টি অক্সিজেন পরমাণু
পরমাণু ও অণুর পার্থক্য:
অণু | পরমাণু |
---|---|
অণু মৌলিক বা যৌগিক পদার্থের অতি ক্ষুদ্রতম কণা। যার স্বাধীন অস্তিত্ব আছে এবং যার মধ্যে ঐ পদার্থের গুণাবলী বিদ্যমান থাকে তাকে অণু বলে। | অণুর ক্ষুদ্রতম কনাকে পরমাণু বলে। এর স্বাধীন অস্তিত্ব নেই কিন্তু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে। |
অণু মৌলিক বা যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা। | পরমাণু মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা। |
অণু স্বাধীনভাবে মুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে | সাধারণত পরমাণু স্বাধীনভাবে মুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে না |
অণু সরাসরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না | পরমাণু সরাসরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে |
পৃথিবীতে যৌগিক পদার্থের সংখ্যা অসংখ্য বলে অণুর সংখ্যাও অসংখ্য | বিভিন্ন প্রকার পরমাণুর সংখ্যা সীমিত। এ পর্যন্ত ১১৮ টি পরমাণু আবিষ্কৃত হয়েছে |
অণুকে ভাঙলে একই বা ভিন্ন মৌলের পরমাণু পাওয়া যায় | পরমাণুকে ভাঙলে ওই মৌলের আর অস্তিত্ব থাকে না |
অণু আকারে বড় | পরমাণুর আকারে অণুর তুলনায় ছোট |
মৌলের প্রতীক কী?
মৌলের পূর্ণ নামের পরিবর্তে এক বা দুইটি ইংরেজি বর্ণ ব্যবহার করে যেই সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশ করা হয়, তাকে মৌলের প্রতীক বলে।
উদাহরণ:
- হাইড্রোজেন → H
- অক্সিজেন → O
- লোহা → Fe
- সোডিয়াম → Na
- সোনা → Au
কিভাবে প্রতীক নির্ধারণ করা হয়?
১. অনেক মৌলের নাম থেকে প্রথম ইংরেজি বর্ণটি নিয়ে প্রতীক তৈরি করা হয়।
- যেমন: Carbon → C, Nitrogen → N
২. যেসব মৌলের ইংরেজি নাম একাধিক মৌলের সঙ্গে মিলে যায়, তাদের জন্য ১ম ও ২য় বর্ণ ব্যবহার করা হয়।
- যেমন: Calcium → Ca, Chlorine → Cl
৩. কিছু প্রতীক প্রাচীন ল্যাটিন নাম থেকে এসেছে।
- যেমন: Iron (লোহা) → Fe (ল্যাটিন: Ferrum)
- Sodium → Na (ল্যাটিন: Natrium)
মৌলের প্রতীকের নিয়ম:
- প্রতীকের প্রথম বর্ণ বড় হাতের (Capital letter) হয়।
- যদি দুইটি বর্ণ থাকে, তাহলে ২য় বর্ণটি ছোট হাতের (Small letter) হয়।
- যেমন: He, Na, Fe
- যেমন: He, Na, Fe
কেন মৌলের প্রতীক প্রয়োজন?
- দীর্ঘ নাম লেখার ঝামেলা কমায়।
- রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো সহজে লেখা যায়।
- আন্তর্জাতিকভাবে এক নিয়মে সব দেশে বোঝা যায়।
রাসায়নিক সংকেত কী?
রাসায়নিক সংকেত হলো মৌলিক পদার্থ বা যৌগিক পদার্থকে বোঝাতে ব্যবহার করা নির্দিষ্ট এক বা একাধিক অক্ষর বা চিহ্ন। এটি মৌল বা যৌগের নামকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করে।
রাসায়নিক সংকেত সাধারণত একটি বা দুটি ইংরেজি অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই সংকেত দেখে আমরা সহজেই বুঝতে পারি কোন মৌল বা পদার্থের কথা বলা হচ্ছে।
মৌলের রাসায়নিক সংকেত
প্রতিটি মৌলের জন্য একটি নির্দিষ্ট সংকেত রয়েছে। এই সংকেতগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং সবার জন্য এক।
সংকেত লেখার নিয়ম
১. যদি সংকেত একটি বর্ণ হয়, তবে সেটি বড় হাতের (Capital) হবে।
২. যদি দুটি বর্ণ হয়, তবে প্রথমটি বড় এবং দ্বিতীয়টি ছোট হাতের (Small) হবে।
উদাহরণ:
মৌলের নাম | সংকেত |
হাইড্রোজেন | H |
হিলিয়াম | He |
লোহা | Fe |
সোনা | Au |
তামা | Cu |
যৌগের রাসায়নিক সংকেত
যখন দুটি বা ততোধিক মৌল একত্রে রাসায়নিক বন্ধনে যুক্ত হয়, তখন তাদের মিলিত সংকেতকে বলে যৌগের রাসায়নিক ।
উদাহরণ:
যৌগের নাম | রাসায়নিক সংকেত |
পানি | H₂O |
কার্বন ডাই-অক্সাইড | CO₂ |
সোডিয়াম ক্লোরাইড | NaCl |
গ্লুকোজ | C₆H₁₂O₆ |
রাসায়নিক সংকেতের গুরুত্ব
- মৌল বা যৌগকে সহজে প্রকাশ করা যায়।
- রাসায়নিক বিক্রিয়া সহজে বোঝা যায়।
- আন্তর্জাতিকভাবে বোঝাপড়ায় সহায়তা করে।
- সময় ও জায়গা সাশ্রয় হয়।
কিছু মৌলের নাম,প্রতীক, সংকেত, ইলেক্ট্রন বিন্যাস,পারমাণবিক সংখ্যা ও আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর তুলে ধরা হলো :
মৌলের নাম | পারমানবিক সংখ্যা | প্রতীক | সংকেত | ইলেক্ট্রন বিন্যাস | যোজনী | আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর |
হাইড্রোজেন | ১ | H | H2 | 1s¹ | ১ | ১ |
হিলিয়াম | ২ | He | He | 1s² | ০ | ৪ |
লিথিয়াম | ৩ | Li | Li | 1s² 2s¹ | ১ | ৭ |
বেরিলিয়াম | ৪ | Be | Be | 1s² 2s² | ২ | ৯ |
বোরন | ৫ | B | B | 1s² 2s² 2p¹ | ৩ | ১১ |
কার্বন | ৬ | C | C | 1s² 2s² 2p² | ২,৪ | ১২ |
নাইট্রোজেন | ৭ | N | N2 | 1s² 2s² 2p³ | ১,২,৩,৪,৫ | ১৪ |
অক্সিজেন | ৮ | O | O2 | 1s² 2s² 2p⁴ | ২ | ১৬ |
ফ্লোরিন | ৯ | F | F2 | 1s² 2s² 2p⁵ | ১ | ১৯ |
নিয়ন | ১০ | Ne | Ne | 1s² 2s² 2p⁶ | ০ | ২০ |
সোডিয়াম | ১১ | Na | Na | 1s² 2s² 2p⁶ 3s¹ | ১ | ২৩ |
ম্যাগনেসিয়াম | ১২ | Mg | Mg | 1s² 2s² 2p⁶ 3s² | ২ | ২৪ |
অ্যালুমিনিয়াম | ১৩ | Al | Al | 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p¹ | ৩ | ২৭ |
সিলিকন | ১৪ | Si | Si | 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p² | ২,৪ | ২৮ |
ফসফরাস | ১৫ | P | P | 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p³ | ৩,৫ | ৩১ |
সালফার | ১৬ | S | S | 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁴ | ২,৪,৬ | ৩২ |
ক্লোরিন | ১৭ | Cl | Cl2 | 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁵ | ১ | ৩৫.৫ |
আর্গন | ১৮ | Ar | Ar | 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁶ | ০ | ৪০ |
পটাসিয়াম | ১৯ | K | K | 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁶ 4s¹ | ১ | ৩৯ |
ক্যালসিয়াম | ২০ | Ca | Ca | 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁶ 4s² | ২ | ৪০ |
স্ক্যান্ডিয়াম | ২১ | Sc | Sc | [Ar] 3d¹ 4s² | ৩ | ৪৫ |
টাইটেনিয়াম | ২২ | Ti | Ti | [Ar] 3d² 4s² | ৩,৪ | ৪৮ |
ভ্যানেডিয়াম | ২৩ | V | V | [Ar] 3d³ 4s² | ২,৩,৪,৫ | ৫১ |
ক্রোমিয়াম | ২৪ | Cr | Cr | [Ar] 3d⁵ 4s¹ | ২,৩,৬ | ৫২ |
ম্যাঙ্গানিজ | ২৫ | Mn | Mn | [Ar] 3d⁵ 4s² | ২,৪ | ৫৫ |
লোহা | ২৬ | Fe | Fe | [Ar] 3d⁶ 4s² | ২,৩ | ৫৬ |
কোবাল্ট | ২৭ | Co | Co | [Ar] 3d⁷ 4s² | ২,৩ | ৫৮ |
নিকেল | ২৮ | Ni | Ni | [Ar] 3d⁸ 4s² | ২ | ৫৯ |
তামা | ২৯ | Cu | Cu | [Ar] 3d¹⁰ 4s¹ | ১ | ৬৩.৫ |
জিঙ্ক | ৩০ | Zn | Zn | [Ar] 3d¹⁰ 4s² | ২ | ৬৫ |
গ্যালিয়াম | ৩১ | Ga | Ga | [Ar] 3d¹⁰ 4s² 4p¹ | ৩ | ৭০ |
জার্মেনিয়াম | ৩২ | Ge | Ge | [Ar] 3d¹⁰ 4s² 4p² | ৪ | ৭৩ |
আর্সেনিক | ৩৩ | As | As | [Ar] 3d¹⁰ 4s² 4p³ | ৩ | ৭৫ |
সেলেনিয়াম | ৩৪ | Se | Se | [Ar] 3d¹⁰ 4s² 4p⁴ | ৪,৬ | ৭৯ |
ব্রোমিন | ৩৫ | Br | Br2 | [Ar] 3d¹⁰ 4s² 4p⁵ | ১ | ৮০ |
ক্রিপটন | ৩৬ | Kr | Kr | [Ar] 3d¹⁰ 4s² 4p⁶ | ০ | ৮৪ |
রুবিডিয়াম | ৩৭ | Rb | Rb | [Kr] 5s¹ | ১ | ৮৬ |
স্ট্রনশিয়াম | ৩৮ | Sr | Sr | [Kr] 5s² | ২ | ৮৮ |
ইট্রিয়াম | ৩৯ | Y | Y | [Kr] 4d¹ 5s² | ৩ | ৮৯ |
জিরকোনিয়াম | ৪০ | Zr | Zr | [Kr] 4d² 5s² | ৪ | ৯১ |
নাইওবিয়াম | ৪১ | Nb | Nb | [Kr] 4d⁴ 5s¹ | ৯৩ | |
মলিবডেনাম | ৪২ | Mo | Mo | [Kr] 4d⁵ 5s¹ | ২,৬ | ৯৬ |
টেকনিশিয়াম | ৪৩ | Tc | Tc | [Kr] 4d⁵ 5s² | ১,৭ | ৯৮ |
রুথেনিয়াম | ৪৪ | Ru | Ru | [Kr] 4d⁷ 5s¹ | ৩,৪ | ১০১ |
রোডিয়াম | ৪৫ | Rh | Rh | [Kr] 4d⁸ 5s¹ | ৩ | ১০৩ |
প্যালেডিয়াম | ৪৬ | Pd | Pd | [Kr] 4d¹⁰ | ২,৪ | ১০৬ |
(রূপা) সিলভার | ৪৭ | Ag | Ag | [Kr] 4d¹⁰ 5s¹ | ১ | ১১০ |
ক্যাডমিয়াম | ৪৮ | Cd | Cd | [Kr] 4d¹⁰ 5s² | ২ | ১১২ |
ইন্ডিয়াম | ৪৯ | In | In | [Kr] 4d¹⁰ 5s² 5p¹ | ৩ | ১১৫ |
টিন (শীশা) | ৫০ | Sn | Sn | [Kr] 4d¹⁰ 5s² 5p² | ৪ | ১১৯ |
অ্যান্টিমনি | ৫১ | Sb | Sb | [Kr] 4d¹⁰ 5s² 5p³ | ৩,৫ | ১২২ |
টেলুরিয়াম | ৫২ | Te | Te | [Kr] 4d¹⁰ 5s² 5p⁴ | ২,৪,৬ | ১২৮ |
আয়োডিন | ৫৩ | I | I2 | [Kr] 4d¹⁰ 5s² 5p⁵ | ১ | ১২৭ |
জেনন | ৫৪ | Xe | Xe | [Kr] 4d¹⁰ 5s² 5p⁶ | ০ | ১৩১ |
সিজিয়াম | ৫৫ | Cs | Cs | [Xe] 6s¹ | ১ | ১৩৩ |
বেরিয়াম | ৫৬ | Ba | Ba | [Xe] 6s² | ২ | ১৩৭ |
ট্যাংস্টেন | ৭৪ | W | W | [Xe] 4f¹⁴ 5d⁴ 6s² | ২,৩,৪,৫,৬ | ১৮৪ |
প্লাটিনাম | ৭৮ | Pt | Pt | [Xe] 4f¹⁴ 5d⁹ 6s¹ | ৪ | ১৯৫ |
গোল্ড (সোনা) | ৭৯ | Au | Au | [Xe] 4f¹⁴ 5d¹⁰ 6s¹ | ১,৩ | ১৯৭ |
মার্কারি (পারদ) | ৮০ | Hg | Hg | [Xe] 4f¹⁴ 5d¹⁰ 6s² | ১,২ | ২০১ |
লেড (সীসা) | ৮২ | Pb | Pb | [Xe] 4f¹⁴ 5d¹⁰ 6s² 6p² | ২,৪ | ২০৭ |
রেডন | ৮৬ | Rn | Rn | [Xe] 4f¹⁴ 5d¹⁰ 6s² 6p⁶ | ০ | ২২২ |
ফ্রানসিয়াম | ৮৭ | Fr | Fr | [Rn] 7s¹ | ১ | ২২৩ |
রেডিয়াম | ৮৮ | Ra | Ra | [Rn] 7s² | ২ | ২২৬ |
ইউরেনিয়াম | ৯২ | U | U | [Rn] 5f³ 6d¹ 7s² | ৪,৬ | ২৩৮ |
পরমাণুর ভিতরের কণা:
মৌল হলো পদার্থের মৌলিক একক, যা প্রতিটি মৌলের ভিতরে অবস্থান করা কণার সমষ্টি। প্রতিটি মৌল তিনটি প্রধান কণার সমন্বয়ে গঠিত: প্রোটন, নিউট্রন, এবং ইলেকট্রন। এগুলি পরমাণুর বিভিন্ন অংশে অবস্থান করে এবং পরমাণুর রাসায়নিক ও পদার্থগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।
১. প্রোটন (Proton)
প্রোটন হলো একটি পজিটিভ চার্জযুক্ত কণা, যার ভর প্রায় ১ অ্যাটমিক মাস ইউনিট (amu)। এটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভিতরে অবস্থান করে। প্রোটনের সংখ্যা একটি মৌলের পার্থক্য নির্ধারণ করে। এই সংখ্যা, যাকে আমরা অ্যাটমিক নাম্বার (atomic number) বলি, একইসাথে মৌলের পরিচিতি প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, হাইড্রোজেনের একটিমাত্র প্রোটন রয়েছে (অ্যাটমিক নাম্বার ১), আর অক্সিজেনের আটটি প্রোটন রয়েছে (অ্যাটমিক নাম্বার ৮)। প্রোটন প্রতিটি মৌলের গঠন এবং বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দেয়।
প্রোটনের বৈশিষ্ট্য:
- আবিষ্কার সাল: 1911
- আবিষ্কারক: আর্নেস্ট রাদারফোর্ড
- আবিষ্কার প্রক্রিয়া: ক্যানাল রশ্মি পরীক্ষা (Anode ray)
- প্রতীক: p বা H⁺
- প্রকৃত ভর: 1.672 × 10⁻²⁴ গ্রাম
- প্রকৃত চার্জ: +1.6 × 10⁻¹⁹ কুলম্ব
- আপেক্ষিক ভর (amu): 1.007
- অবস্থান: নিউক্লিয়াসে (পরমাণুর কেন্দ্র)
২. নিউট্রন (Neutron)
নিউট্রন হলো চার্জহীন কণা, অর্থাৎ এর কোন বৈদ্যুতিন চার্জ নেই। নিউট্রনের ভরও প্রোটনের মতো প্রায় ১ অ্যাটমিক মাস ইউনিট (amu)। এটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সাথে যুক্ত থাকে। নিউট্রনের প্রধান কাজ হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনদের মধ্যে পারস্পরিক আধান প্রতিরোধক বল তৈরি করা। নিউট্রন না থাকলে, প্রোটনরা পরস্পরের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করতে পারে, কারণ তারা সবই পজিটিভ চার্জযুক্ত। নিউট্রন এদেরকে একে অপর থেকে দূরে রাখে এবং নিউক্লিয়াসের স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
নিউট্রনের বৈশিষ্ট্য:
- আবিষ্কার সাল: 1932
- আবিষ্কারক: জেমস চ্যাডউইক
- আবিষ্কার প্রক্রিয়া: বেরিলিয়াম (Be) নিউক্লিয়াসে α-কণার আঘাত
- প্রতীক: n
- প্রকৃত ভর: 1.675 × 10⁻²⁴ গ্রাম
- প্রকৃত চার্জ: কোনো চার্জ নেই (নিরপেক্ষ)
- আপেক্ষিক ভর (amu): 1.0089
- অবস্থান: নিউক্লিয়াসে (প্রোটনের পাশে)
৩. ইলেকট্রন (Electron)
ইলেকট্রন হলো একটি নেগেটিভ চার্জযুক্ত কণা, যার ভর প্রায় ১/১৮৩৬ অ্যাটমিক মাস ইউনিট (amu)। এটি নিউক্লিয়াসের চারপাশে অবস্থিত কক্ষপথে (orbit) চলাফেরা করে। ইলেকট্রন এবং প্রোটনের চার্জ একে অপরকে ভারসাম্য রাখে, ফলে পরমাণু মোটের উপর বৈদ্যুতিনভাবে নিরপেক্ষ থাকে। ইলেকট্রনের সংখ্যা সাধারণত প্রোটনের সমান হয়, যাতে পরমাণুর মোট চার্জ শূন্য থাকে।
ইলেকট্রনের অবস্থান এবং গতির উপর নির্ভর করে পরমাণুর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ধারিত হয়। বিশেষ করে, ইলেকট্রনের শেষ কক্ষে (valence shell) থাকা ইলেকট্রনগুলির সংখ্যা এবং তাদের গতির বৈশিষ্ট্যই একটি মৌলের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া এবং বন্ধন গঠনকে প্রভাবিত করে।
ইলেকট্রনের বৈশিষ্ট্য:
- আবিষ্কার সাল: 1897
- আবিষ্কারক: জে. জে. থমসন
- আবিষ্কার প্রক্রিয়া: ক্যাথোড রশ্মি পরীক্ষা
- প্রতীক: e⁻
- প্রকৃত ভর: 9.11 × 10⁻²⁸ গ্রাম
- প্রকৃত চার্জ: −1.6 × 10⁻¹⁹ কুলম্ব
- আপেক্ষিক ভর (amu): 5.488 × 10⁻⁴
- অবস্থান: পরমাণুর বাইরের শেলে (shell/orbit)
পারমাণবিক সংখ্যা (Atomic Number)
সংজ্ঞা:
পারমাণবিক সংখ্যা হচ্ছে একটি মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনের সংখ্যা। এটি প্রতিটি মৌলের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এই সংখ্যার মাধ্যমেই একটি মৌলকে অন্য মৌল থেকে আলাদা করা যায়।
চিহ্ন:
পারমাণবিক সংখ্যা সাধারণত ইংরেজি বর্ণ Z দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
উদাহরণ:
- হাইড্রোজেন (H) – এর নিউক্লিয়াসে ১টি প্রোটন, অর্থাৎ Z = 1
- হিলিয়াম (He) – এর নিউক্লিয়াসে ২টি প্রোটন, অর্থাৎ Z = 2
- কার্বন (C) – Z = 6 (৬টি প্রোটন)
- অক্সিজেন (O) – Z = 8 (৮টি প্রোটন)
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- পারমাণবিক সংখ্যা = প্রোটনের সংখ্যা = ইলেকট্রনের সংখ্যা (নিরপেক্ষ পরমাণুর ক্ষেত্রে)
- মৌলের নাম ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে পারমাণবিক সংখ্যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- পারমাণবিক সংখ্যা পরিবর্তন হলে সম্পূর্ণ নতুন মৌল তৈরি হয়।
ভর সংখ্যা (Mass Number)
সংজ্ঞা:
ভর সংখ্যা হচ্ছে একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা।
চিহ্ন:
ভর সংখ্যা সাধারণত ইংরেজি বর্ণ A দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

সূত্র:ভর সংখ্যা (A) = প্রোটনের সংখ্যা (Z) + নিউট্রনের সংখ্যা (N)
উদাহরণ:
- কার্বন-১২ (C-12):
প্রোটন = ৬, নিউট্রন = ৬
ভর সংখ্যা A = ৬ + ৬ = ১২ - অক্সিজেন-১৬ (O-16):
প্রোটন = ৮, নিউট্রন = ৮
ভর সংখ্যা A = ৮ + ৮ = ১৬
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- ভর সংখ্যা পরমাণুর ভরের একটি ধারণা দেয় (যদিও প্রকৃত ভর একটু আলাদা হতে পারে কারণ পরমাণুর ভরের কিছু অংশ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়)।
একই মৌলের ভিন্ন ভর সংখ্যার পরমাণুগুলিকে আইসোটোপ বলে (যেমনঃ কার্বন-১২ ও কার্বন-১৪)।
রাদারফোর্ড এর পরমাণু মডেল
নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড তার ছাত্রদের নিয়ে একটি অদ্ভুত পরীক্ষা করেন। তারা সোনার একটি পাতলা পাতের ওপর দিয়ে অ্যালফা কণার একটি রশ্মি ছুঁড়ে দেন এবং দেখে নেন, কণাগুলো কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়।
তাদের প্রত্যাশা ছিল — সব কণা সোজা চলে যাবে। কারণ, তৎকালীন ‘থমসনের প্লাম-পুডিং মডেল’ অনুসারে পরমাণু ছিল একটা “কেকের মতো” — যেখানে ধনাত্মক আধান সারা পরমাণুতে ছড়িয়ে আছে, আর ইলেকট্রনগুলো কিসের মতো তাতে বসে আছে।
কিন্তু ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা!
- অধিকাংশ কণা সোজা চলে গেল,
- কিন্তু কিছু কণা হঠাৎ দিক পরিবর্তন করল,
- আর কয়েকটি কণা সম্পূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এল!
রাদারফোর্ড বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন:
“এটা যেন এমন, আপনি একটা কাগজে গুলি করলেন, আর সেটা ফিরে এসে আপনাকেই লাগল!”
এই আবিষ্কার থেকেই তিনি সিদ্ধান্তে আসেন — পরমাণুর বেশিরভাগ অংশ ফাঁকা, আর তার কেন্দ্রে রয়েছে একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র কিন্তু ঘন “নিউক্লিয়াস”।
এই মজার ঘটনাই আজকের পরমাণু মডেলের মূল ভিত্তি
রাদারফোর্ডের পরীক্ষাই প্রথম দেখায় যে, পরমাণুতে একটি কেন্দ্র থাকে, যেখানে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে, আর ইলেকট্রন ঘুরে বেড়ায় বাইরে কক্ষপথে।
রাদারফোর্ডের সোনার পাত পরীক্ষা (Gold Foil Experiment)

পরীক্ষার বিবরণ:
রাদারফোর্ড তাঁর দুই সহকারী গেইগার ও মার্সডেন-এর সঙ্গে একটি বিখ্যাত পরীক্ষা করেন, যাকে আমরা “সোনার পাত পরীক্ষা” (Gold Foil Experiment) বলি। এই পরীক্ষায় তিনি:
- একটি পাতলা সোনার পাত (gold foil)-এর ওপর আলফা কণা (α-particles) ছুঁড়েছিলেন।
- তিনি দেখতে পেলেন:
- বেশিরভাগ আলফা কণা সোজা চলে যায়।
- কিছু কণা সামান্য বেঁকে যায়।
- খুব অল্প কণা সম্পূর্ণ উল্টো দিকে প্রতিফলিত হয়।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের স্বীকার্য:
- প্রতিটি পরমাণুর কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্র, ঘন এবং ধনাত্মক কণিকা থাকে, যাকে নিউক্লিয়াস বলা হয়।
পরমাণুর মোট ভরের প্রায় সবটাই নিউক্লিয়াসে কেন্দ্রীভূত থাকে। - নিউক্লিয়াস ধনাত্মক চার্জযুক্ত।
এটি প্রোটনের উপস্থিতির কারণে হয়। নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রনকে দূরে রাখার জন্য এই ধনাত্মক চার্জ গুরুত্বপূর্ণ। - ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে উচ্চ গতিতে কক্ষপথে ঘোরে।
অনেকটা সৌরজগতের মতো – যেখানে গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে ঘোরে। - পরমাণুর অধিকাংশ স্থান ফাঁকা।
কারণ অধিকাংশ α-কণা সোজা চলে যায় এবং কিছুমাত্র কণা বিচ্যুত হয়। - নিউক্লিয়াস পরমাণুর খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ হলেও এতে পরমাণুর প্রায় সম্পূর্ণ ভর কেন্দ্রীভূত।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের সীমাবদ্ধতা:
- ইলেকট্রন কক্ষপথে ঘুরতে থাকলে তা শক্তি হারায় – কিন্তু রাদারফোর্ড তা ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
পদার্থবিদ্যার মতে, চার্জযুক্ত কণা ঘূর্ণন করলে তা শক্তি বিকিরণ করে এবং ধীরে ধীরে নিউক্লিয়াসে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। - ইলেকট্রনের অবস্থান বা শক্তিস্তর সম্পর্কে কিছু বলে না।
ইলেকট্রন কীভাবে নির্দিষ্ট কক্ষপথে থাকে বা তাদের শক্তি কত — এসব ব্যাখ্যা এই মডেলে নেই। - পরমাণুর বর্ণালির ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
হাইড্রোজেনের মতো সহজ পরমাণুর নির্দিষ্ট রঙের (লাইনের) বর্ণালি পাওয়া যায়, কিন্তু রাদারফোর্ডের মডেল তা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়। - ইলেকট্রনের স্থিতিশীল কক্ষপথের কোনো ধারণা নেই।
ইলেকট্রন কেন নিউক্লিয়াসে পড়ে না যায় বা কীভাবে তা স্থিতিশীলভাবে ঘোরে — এসব প্রশ্নের উত্তর এই মডেলে ছিল না।
বোরের পরমাণু মডেল (Bohr’s Atomic Model)
১৯১৩ সালে নীলস বোর রাদারফোর্ডের মডেলের সীমাবদ্ধতা দূর করতে একটি নতুন মডেল প্রস্তাব করেন। তিনি মূলত হাইড্রোজেন পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতে এই মডেল দেন।

বোর মডেলের মূল স্বীকার্যসমূহ (Postulates of Bohr’s Model)
১। শক্তিস্তর সম্পর্কিত মতবাদ
- নিউক্লিয়াসের চারদিকে নির্দিষ্ট শক্তির কিছু বৃত্তাকার কক্ষপথ বা অরবিট থাকে।
- প্রতিটি অরবিট একটি নির্দিষ্ট শক্তির স্তর বা শক্তিস্তর (energy level) নির্দেশ করে, যেগুলোকে প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা (n=1,2,3,…) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
- ইলেকট্রন এ কক্ষপথে ঘুরে বেড়ালেও কোনো শক্তি বিকিরণ বা শোষণ করে না।
- নিউক্লিয়াস থেকে যত দূরে শক্তিস্তর, তত বেশি শক্তির স্তর এবং ইলেকট্রনের শক্তিও বেশি।
২। কৌণিক ভরবেগ সম্পর্কিত মতবাদ
- প্রতিটি স্থির শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ (angular momentum) নির্দিষ্ট ও কুয়ান্টাইজড।
- সূত্র:
mvr= nh / 2π = nℏ যেখানে,- m = ইলেকট্রনের ভর
- v = ইলেকট্রনের গতি
- r = কক্ষপথের ব্যাসার্ধ
- h = প্লাঙ্কের ধ্রুবক
- n = প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা
৩। বর্ণালী সম্পর্কিত মতবাদ
- ইলেকট্রন যখন এক শক্তিস্তর থেকে অন্য স্তরে যায়, তখন নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে।
- শক্তি পরিবর্তনের পরিমাণ:
ΔE = E2−E1 = hν - অথবা,
λ=hc / ΔE যার মাধ্যমে নির্গত তরঙ্গদৈর্ঘ্য (λ) এবং বিকিরিত বর্ণের প্রকৃতি নির্ণয় করা যায়।
বোর মডেলের সীমাবদ্ধতা (Limitations of Bohr’s Model)
- একমাত্র এক ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণু (যেমন: H, He⁺, Li²⁺) ও আয়নের বর্ণালি ব্যাখ্যা করতে পারে; বহু ইলেকট্রনবিশিষ্ট পরমাণুতে প্রযোজ্য নয়।
- পরমাণুকে দ্বিমাত্রিকভাবে উপস্থাপন করে, বাস্তবের ত্রিমাত্রিক গঠন বোঝায় না।
- জীম্যান প্রভাব (চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব) এবং স্টার্ক প্রভাব (তড়িৎ ক্ষেত্রের প্রভাব) ব্যাখ্যা করতে পারে না।
- সূক্ষ্ম বর্ণালি রেখার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ; সমারফিল্ড পরবর্তীতে ব্যাখ্যা দেন।
- বর্ণালি রেখার তীব্রতা ব্যাখ্যা করতে অক্ষম।
- ইলেকট্রনের অবস্থান ও গতি একই সঙ্গে নির্ভুলভাবে জানানো সম্ভব — যা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতির পরিপন্থী।
- কৌণিক ভরবেগ কেন nh / 2π হবে, তার ব্যাখ্যা দেয় না।
বোর মডেলের সাফল্য (Successes of Bohr’s Model)
- পরমাণুর স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা — ইলেকট্রন স্থায়ী কক্ষপথে শক্তি বিকিরণ না করায় নিউক্লিয়াসে পড়ে না।
- H-পরমাণুর রেখা বর্ণালির ব্যাখ্যা সফলভাবে করতে পেরেছে।
- প্রথম কক্ষপথের ব্যাসার্ধ নির্ণয় — 0.529×10-10 = 0.529 Å।
- প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যার ধারণা দিয়েছে।
- কক্ষপথভিত্তিক শক্তিমাত্রা নির্ণয় করে শক্তি পরিবর্তনের হিসাব সম্ভব করেছে।
- রিডবার্গ ধ্রুবক ব্যাখ্যা করেছে, যা পরীক্ষালব্ধ মানের সাথে মিলে গেছে।
- আয়নীকরণ শক্তি নির্ণয়ে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মান দিয়েছে।
পরমাণুর গঠন ও শক্তি:

প্রোটন, নিউট্রন এবং ইলেকট্রন, এই তিনটি কণার সমন্বয়ে পরমাণুর গঠন সম্পন্ন হয়। প্রোটন এবং নিউট্রন নিউক্লিয়াসে কেন্দ্রীভূত থাকে, যেখানে নিউট্রন পরমাণুর ভর এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ইলেকট্রনরা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে এবং তাদের গতির মাধ্যমে মৌলের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।
নিউক্লিয়াস কী?
নিউক্লিয়াস হল পরমাণুর কেন্দ্রস্থল বা কেন্দ্রীয় অংশ, যেখানে পরমাণুর প্রায় সম্পূর্ণ ভর সঞ্চিত থাকে। এটি প্রোটন ও নিউট্রন দ্বারা গঠিত।
নিউক্লিয়াসের বৈশিষ্ট্য:
- নিউক্লিয়াস পরমাণুর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে।
- এটি গঠিত হয় দুইটি উপণ্ণ কণা দিয়ে:
প্রোটন (p⁺) – ধনাত্মক চার্জযুক্ত
নিউট্রন (n⁰) – কোনো চার্জ নেই (নিরপেক্ষ) - নিউক্লিয়াস সবসময় ধনাত্মক চার্জযুক্ত, কারণ প্রোটন আছে।
- নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন ও নিউট্রনের সম্মিলিত সংখ্যা হল ভর সংখ্যা (Mass Number)।
- নিউক্লিয়াসের আয়তন অনেক ছোট হলেও এটিতে প্রায় সম্পূর্ণ পরমাণুর ভর থাকে।
- পরমাণুর বাইরের কক্ষপথে থাকা ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
ইলেকট্রনের কক্ষপথ কী?
ইলেকট্রনের কক্ষপথ হলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে ইলেকটনের ঘূর্ণন পথ। এই কক্ষপথগুলোকে শক্তিস্তর (Energy Levels), শেল (Shell) বা উপবৃত্তাকার কক্ষপথ বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- ইলেকট্রন সবসময় নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
- এরা নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা কক্ষপথে অবস্থান করে, যেগুলোকে K, L, M, N… (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়…) শক্তিস্তর বলা হয়।
- বোরের মডেলে যে শক্তিস্তরের কথা বলা হয়েছে তাকে প্রধান শক্তিস্তর বলা হয়। প্রতিটি প্রধান শক্তিস্তরের সর্বোচ্চ ইলেকট্রন ধারণ ক্ষমতা 2n² যেখানে n = 1, 2, 3, 4 ইত্যাদি। অতএব এ সূত্রানুসারে :
K শক্তিস্তরের জন্য n = 1 অতএব K শক্তিস্তরে সর্বোচ্চ ইলেকট্রন থাকতে পারে 2n² =2×1² = 2টি
L শক্তিস্তরের জন্য n = 2 অতএব L শক্তিস্তরে সর্বোচ্চ ইলেকট্রন থাকতে পারে 2n²= 2×2² = 8টি
M শক্তিস্তরের জন্য n = 3 অতএব M শক্তিস্তরে সর্বোচ্চ ইলেকট্রন থাকতে পারে 2n² = 2×3² = 18টি
N শক্তিস্তরের জন্য n = 4 অতএব N শক্তিস্তরে সর্বোচ্চ ইলেকট্রন থাকতে পারে 2n² = 2×4² = 32টি
- ইলেকট্রন নিচের স্তর পূর্ণ না হলে উপরের স্তরে যেতে পারে না।
- ইলেকট্রন কেবল নির্দিষ্ট শক্তির কক্ষপথে অবস্থান করতে পারে — একে বোর (Bohr) মডেল বলে।
উপকক্ষপথ কী?
উপকক্ষপথ (Orbital) হলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, যেখানে ইলেকট্রনের থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এটি নির্দিষ্ট কোনো গতি পথ নয়, বরং একটি সম্ভাব্যতা অঞ্চল, যেখানে ইলেকট্রনকে পাওয়া যেতে পারে।
এই ধারণা এসেছে আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে। যেখানে ইলেকট্রনকে একটি “কণা” এবং “তরঙ্গ” উভয়ের আচরণ বিশ্লেষণ করে এর উপস্থিতির অঞ্চল নির্ধারণ করা হয়।
উপশক্তিস্তরকে ℓ (l) দ্বারা বোঝানো হয়, যার মান হয়: ℓ = 0 থেকে (n – 1) পর্যন্ত।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ Note:
- প্রতিটি ℓ-এর জন্য অরবিটালের সংখ্যা = 2ℓ + 1
যেমনঃ- ℓ = 0 ⇒ 1 অরবিটাল (s)
- ℓ = 1 ⇒ 3 অরবিটাল (pₓ, pᵧ, p𝓏)
- ℓ = 2 ⇒ 5 অরবিটাল (d)
- ℓ = 3 ⇒ 7 অরবিটাল (f)
- ℓ = 0 ⇒ 1 অরবিটাল (s)
- প্রতিটি অরবিটালে সর্বোচ্চ ২টি ইলেকট্রন থাকতে পারে।
- পূর্ণ শক্তিস্তরে ইলেকট্রন সংখ্যা = 2n²
যেমনঃ- n = 1 হলে → 2(1)² = 2
- n = 2 হলে → 2(2)² = 8
- n = 3 হলে → 2(3)² = 18
- n = 1 হলে → 2(1)² = 2
উপশক্তিস্তর ও অরবিটাল:
প্রতিটি প্রধান শক্তিস্তর (n = 1, 2, 3, …) আবার বিভক্ত হয় উপশক্তিস্তরে (sub-shell)। প্রতিটি উপশক্তিস্তর আবার এক বা একাধিক অরবিটালে বিভক্ত।
উপশক্তিস্তর | মোট অরবিটাল সংখ্যা | সর্বোচ্চ ইলেক্ট্রন সংখ্যা |
1s | 1 | 2 |
2s, 2p | 1 + 3 = 4 | 8 |
3s, 3p, 3d | 1 + 3 + 5 = 9 | 18 |
4s, 4p, 4d, 4f | 1 + 3 + 5 + 7 = 16 | 32 |
অরবিটাল বা উপকক্ষপথের প্রকারভেদ:
s অরবিটাল (s Orbital)

- আকৃতি: সুষম গোলাকার।
- কেন্দ্র: নিউক্লিয়াস অবস্থিত কেন্দ্রবিন্দুতে।
- সহকারী কোয়ান্টাম সংখ্যা: l=0
- চুম্বকীয় কোয়ান্টাম সংখ্যা: m=0 → একটি মাত্র s অরবিটাল
- ইলেকট্রন ঘনত্ব: x, y, z অক্ষে সমানভাবে বিস্তৃত
- প্রধান শক্তিস্তর বাড়লে: অরবিটালের আয়তন বাড়ে (1s < 2s < 3s)
- Node:
- 1s → কোনো node নেই
- 2s → ১টি node
- 3s → ২টি node
- সাধারণ নিয়ম: node সংখ্যা= n−1
p অরবিটাল (p Orbital)

- আকৃতি: ডাম্বেল বা দুটি লোবযুক্ত
- সহকারী কোয়ান্টাম সংখ্যা: l = 1
- চুম্বকীয় কোয়ান্টাম সংখ্যা: m=−1,0,+1 → px, py, pz (তিনটি অরবিটাল)
- প্রতিটি অরবিটালের দিক:
- px: x অক্ষ বরাবর
- py: y অক্ষ বরাবর
- pz: z অক্ষ বরাবর
- নোডাল তল (Nodal plane): ইলেকট্রনের উপস্থিতি প্রায় শূন্য

- px → yz তলে node
- py → xz তলে node
- pz → xy তলে node
d অরবিটাল (d Orbital)

- আকৃতি: জটিল, অধিকাংশই ডাবল ডাম্বেল ধরনের
- সহকারী কোয়ান্টাম সংখ্যা: l = 2
- চুম্বকীয় কোয়ান্টাম সংখ্যা: m=−2,−1,0,+1,+2 → পাঁচটি ভিন্ন d অরবিটাল
নোডাল তল (Nodal plane):

- dxy: x-y অক্ষের মাঝে (45° কোণে)
- dyz: y-z অক্ষের মাঝে
- dzx: z-x অক্ষের মাঝে
- dx2−y2: x ও y অক্ষ বরাবর
- dz2: z অক্ষে ডাম্বেল ও মাঝখানে চক্রাকার মেঘ
f অরবিটাল (f-orbital)
- আকার: আরও জটিল
- প্রতিটি f-sub-shell এ ৭টি অরবিটাল থাকে
- সর্বোচ্চ ১৪টি ইলেকট্রন ধারণ করতে পারে

অরবিট ও অরবিটালের পার্থক্য :
বিষয় | অরবিট | অরবিটাল |
সংজ্ঞা | অরবিট হলো একটি নির্দিষ্ট বৃত্তাকার পথ, যেখানে ইলেকট্রন পরমাণুর কেন্দ্রে অবস্থিত নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘুরে বেড়ায় | উপকক্ষপথ (Orbital) হলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, যেখানে ইলেকট্রনের থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি |
মডেলের উৎস | বোর পরমাণু মডেল | কোয়ান্টাম মডেল (হাইজেনবার্গ, শ্রোডিঙ্গার) |
ধারণার প্রকৃতি | নির্দিষ্ট বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার পথ | ইলেকট্রনের অবস্থান সম্ভাবনার একটি অঞ্চল |
ইলেকট্রনের গতি | ইলেকট্রন নির্দিষ্ট পথে ঘোরে | ইলেকট্রনের সুনির্দিষ্ট গতি বলা যায় না |
স্থান | ২-মাত্রিক (2D) পথ | ৩-মাত্রিক (3D) অঞ্চল |
আকার | সব অরবিটের আকার একই (বৃত্তাকার) | বিভিন্ন রকম আকৃতি হয় (s: গোলাকার, p: ডাম্ববেল ইত্যাদি) |
ইলেকট্রনের সংখ্যা | প্রতিটি অরবিটে অনেক ইলেকট্রন থাকতে পারে | এক অরবিটালে সর্বোচ্চ ২টি ইলেকট্রন থাকতে পারে |
শক্তিস্তরের ধারণা | প্রতিটি অরবিট একটি শক্তিস্তর নির্দেশ করে | অরবিটাল শক্তিস্তরের উপস্তর বোঝায় |
গাণিতিক ভিত্তি | গাণিতিকভাবে নির্ভুল নয় | গাণিতিক সমীকরণ (শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ) দ্বারা নির্ধারিত |
স্পিন ধারণা | স্পিনের কোনো ব্যাখ্যা নেই | ইলেকট্রনের স্পিন (↑ বা ↓) ধারণা থাকে |
বৈজ্ঞানিক গ্রহণযোগ্যতা | আধুনিক বিজ্ঞানে পরিত্যক্ত | আধুনিক বিজ্ঞান ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সে গ্রহণযোগ্য |
ইলেক্ট্রন ধারন ক্ষমতা | সর্বোচ্চ ইলেক্ট্রন ধারন ক্ষমতা = 2n2 | সর্বোচ্চ ইলেক্ট্রন ধারন ক্ষমতা =2(2l + 1) |
ইলেক্ট্রন গন্যতা | ইলেক্ট্রনকে কণা হিসেবে গন্য করা হয় | ইলেক্ট্রনকে তরঙ্গ হিসেবে গন্য করা হয় |
পরমাণুর শক্তিস্তরে ইলেকট্রন বিন্যাস (Electron Configuration in Energy Levels)
ইলেকট্রন বিন্যাসের নিয়ম:
সর্বনিম্ন শক্তির অরবিটাল আগে পূর্ণ হয়।
অরবিটালের শক্তি নির্ভর করে তার n + ℓ মানের উপর।
- n = প্রধান শক্তিস্তরের মান (Principal Quantum Number)
- ℓ = উপশক্তিস্তরের মান (Azimuthal Quantum Number)
যেই অরবিটালের (n + ℓ) কম, সেই অরবিটালে ইলেকট্রন আগে প্রবেশ করে।
যদি দুইটি অরবিটালের (n + ℓ) সমান হয়, তবে n যেটির কম, সেটির শক্তি কম—ইলেকট্রন সেখানেই আগে যাবে।

উদাহরণ:
অরবিটাল | প্রধান শক্তিস্তর n | উপশক্তিস্তরের মান l | (n + ℓ) | শক্তির অবস্থান |
1s | 1 | 0 | 1 | 1 |
2s | 2 | 0 | 2 | 2 |
2p | 2 | 1 | 3 | 3 |
3s | 3 | 0 | 3 | 4 |
3p | 3 | 1 | 4 | 5 |
4s | 4 | 0 | 4 | 6 |
3d | 3 | 2 | 5 | 7 |
4p | 4 | 1 | 5 | 8 |
5s | 5 | 0 | 5 | 9 |
ইলেকট্রন বিন্যাসে কিছু ব্যতিক্রম (Exceptions in Electron Configuration)
আফবাউ, পাউলি ও হান্ডের নিয়ম মেনেই সাধারণত ইলেকট্রন বিন্যাস নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কিছু কিছু মৌল আছে যাদের ক্ষেত্রে এই নিয়মগুলো পুরোপুরি অনুসরণ করে না। এদের ইলেকট্রন বিন্যাসে দেখা যায় ব্যতিক্রম।
এই ব্যতিক্রমের কারণ হলো অতিরিক্ত স্থিতিশীলতা (extra stability), যা কিছু নির্দিষ্ট কক্ষপথের অর্ধ-পূর্ণ বা পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায়।
কেন ব্যতিক্রম ঘটে?
ইলেকট্রন বিন্যাসে ব্যতিক্রম মূলত ঘটে যখন:
- d-অরবিটাল অর্ধ-পূর্ণ (5 ইলেকট্রন) বা পূর্ণ (10 ইলেকট্রন) হলে সেটি বিশেষভাবে স্থিতিশীল হয়।
- তাই কখনো কখনো s-অরবিটাল থেকে ১টি ইলেকট্রন d-অরবিটালে চলে গিয়ে এটিকে স্থিতিশীল করে।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যতিক্রম উদাহরণ:
১. ক্রোমিয়াম (Chromium, Cr)
পারমাণবিক সংখ্যা = 24
আফবাউ অনুযায়ী:
Cr: 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁶ 4s² 3d⁴
(→ ভুল)
সঠিক বিন্যাস (ব্যতিক্রম):
Cr: 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁶ 4s¹ 3d⁵
কারণ: 3d⁵ অর্ধ-পূর্ণ হওয়ায় বেশি স্থিতিশীল
২. কপার (Copper, Cu)
পারমাণবিক সংখ্যা = 29
আফবাউ অনুযায়ী:
Cu: 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁶ 4s² 3d⁹
(→ ভুল)
সঠিক বিন্যাস (ব্যতিক্রম):
Cu: 1s² 2s² 2p⁶ 3s² 3p⁶ 4s¹ 3d¹⁰
কারণ: 3d¹⁰ পূর্ণ হওয়ায় বেশি স্থিতিশীল
৩. মলিবডিনাম (Mo), রুপা (Ag), সোনা (Au), নিকেল (Ni)
এদের ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে ব্যতিক্রম দেখা যায়। মূলত d-ব্লকের কিছু মৌলের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম বেশি ঘটে।
আইসোটোপ (Isotope):
আইসোটোপ কী?

আইসোটোপ হল একই মৌলের এমন সব পরমাণু যাদের পারমাণবিক সংখ্যা সমান কিন্তু ভর সংখ্যা ভিন্ন।
অর্থাৎ, তাদের প্রোটন সংখ্যা একই থাকে, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন হয়।
আইসোটোপের ধর্ম
- এক মৌলের আইসোটোপে প্রোটন ও ইলেকট্রন সংখ্যা সমান থাকে।
- ইলেকট্রন বিন্যাস এক হওয়ার ফলে রাসায়নিক ধর্ম একই হয়।
- নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন হওয়ায় ভৌত ধর্ম কিছুটা ভিন্ন হয়।
- ভর ভিন্ন হওয়ার কারণে এক আইসোটোপকে অন্যটি থেকে আলাদা করা যায়।
অস্থিতিশীল আইসোটোপ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ করে, একে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বলে।
আরও কিছু সাধারণ আইসোটোপের উদাহরণ:


আইসোটোপের ধরণ
আইসোটোপগুলোকে তাদের স্থিতিশীলতার উপর ভিত্তি করে দুই ধরনের ভাগে ভাগ করা হয়:
স্থির আইসোটোপ এবং অস্থিতিশীল (রেডিওএকটিভ) আইসোটোপ। এছাড়াও রয়েছে আরেকটি বিশেষ ধরনের আইসোটোপ, যাকে বলা হয় প্রাইমোর্ডিয়াল আইসোটোপ। চলুন এদের বিস্তারিতভাবে জানি।
১. স্থির আইসোটোপ (Stable Isotopes)
স্থির আইসোটোপ এমন সব আইসোটোপ যাদের হাফ-লাইফ অনেক বেশি — অর্থাৎ তারা হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ বছরেও ভেঙে পড়ে না।
উদাহরণস্বরূপ:
- কার্বন: কার্বন-১২, কার্বন-১৩
- অক্সিজেন: অক্সিজেন-১৬, অক্সিজেন-১৭, অক্সিজেন-১৮
২. রেডিওএকটিভ আইসোটোপ (Radioactive Isotopes)
রেডিওএকটিভ আইসোটোপ অস্থিতিশীল হয় এবং দ্রুত ভেঙে পড়ে। এই ভাঙার সময় তারা অ্যালফা, বিটা বা গামা রশ্মি নির্গত করে।
উদাহরণস্বরূপ:
- ট্রাইটিয়াম
- কার্বন-১৪
এই রেডিওএকটিভ আইসোটোপগুলো সাধারণত নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর বা পার্টিকেল অ্যাক্সেলারেটরের মাধ্যমে তৈরি করা হয়, তবে কিছু প্রাকৃতিকভাবেও পাওয়া যায়।
৩. প্রাইমোর্ডিয়াল আইসোটোপ (Primordial Isotopes)
প্রাইমোর্ডিয়াল আইসোটোপ হলো সেই সব নিউক্লাইড যা সৌরজগত সৃষ্টির সময় থেকেই বিদ্যমান।
পৃথিবীতে মোট ৩৩৯টি প্রাকৃতিক আইসোটোপ আছে, যার মধ্যে ২৮৬টি প্রাইমোর্ডিয়াল।
ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ
ইউরেনিয়াম একটি প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া রেডিওএকটিভ উপাদান যার সবগুলো আইসোটোপই অস্থিতিশীল। তবে কিছু আইসোটোপ যেমন U-235 ও U-238 অনেক দীর্ঘ হাফ-লাইফের জন্য উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে U-238 পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় এবং এটি গবেষণা ও পারমাণবিক কাজে ব্যবহার হয়।
আইসোটোপের ব্যবহার:
আইসোটোপের চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহার
- আয়োডিন-১৩১ (Iodine-131)
➤ থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। - টেকনিশিয়াম-৯৯ (Technetium-99)
➤ থাইরয়েড ফাংশন পরীক্ষা করার কাজে ব্যবহৃত হয়। - রক্তপ্রবাহ পরীক্ষায়
➤ ধমনিতে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ প্রবাহিত করে সরু ধমনীতে সমস্যা শনাক্ত করা যায়। - ক্যান্সার শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা
➤ ক্যান্সার কোষে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ পাঠিয়ে তাদের অবস্থান নির্ধারণ ও ধ্বংস করা হয়। - চিকিৎসা যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্তকরণ
➤ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে অস্ত্রোপচারের যন্ত্র জীবাণুমুক্ত করা হয়।
যায়।
আইসোটোপের কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার:

- পোকামাকড় ও পরজীবী নিয়ন্ত্রণে
➤ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকামাকড় ধ্বংস করা হয়। - ফসলের ফলন বৃদ্ধি
➤ তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের সাহায্যে ফসলের প্রয়োজনীয় সার ও তার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। - মাটির পুষ্টিগুণ বিশ্লেষণ
➤ মাটিতে পুষ্টির গতিপথ নির্ধারণ করে কোন এলাকায় কী ধরনের ফসল ভালো ফলবে তা জানা যায়। - সেচের পানির ব্যবহার পর্যবেক্ষণ
➤ তেজস্ক্রিয় ট্রেসার ব্যবহার করে পানি সেচের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা যায়।
খাদ্য সংরক্ষণে আইসোটোপের ব্যবহার:
- খাদ্য জীবাণুমুক্তকরণে ব্যবহৃত হয়
➤ তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে নির্গত বিকিরণ ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক ধ্বংস করে। - ফলমূল ও শাকসবজি সংরক্ষণে সাহায্য করে
➤ ফলমূল দীর্ঘদিন তাজা রাখার জন্য তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রয়োগ করা হয়। - খাদ্যদ্রব্যের পচন রোধ করে
➤ বিকিরণের মাধ্যমে খাদ্যের পচনশীল এনজাইম ধ্বংস করা হয়। - রফতানিযোগ্য খাদ্যের মান বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়
➤ আন্তর্জাতিক মানের খাদ্য সংরক্ষণের জন্য এই প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় আইসোটোপের ব্যবহার:
- জীবাশ্মের বয়স নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়
➤ তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের ক্ষয় হারের ভিত্তিতে জীবাশ্মের সঠিক বয়স নির্ধারণ করা যায়। - কার্বন-১৪ ডেটিং পদ্ধতি
➤ জীবাশ্মজাত নমুনার বয়স নির্ণয়ে কার্বন-১৪ আইসোটোপ ব্যবহৃত হয় (বিশেষত জীবিত প্রাণীর থেকে আসা জৈব বস্তুতে)। - পাথর ও খনিজের বয়স নির্ণয়ে
➤ ইউরেনিয়াম-লেড (U-Pb) ডেটিং, পটাশিয়াম-আর্জোন (K-Ar) ডেটিং এর মতো পদ্ধতিতে আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়। - পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস বোঝার কাজে সহায়তা করে
➤ আইসোটোপিক বিশ্লেষণ থেকে আমরা ভূগর্ভস্থ পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরি উদ্গিরণ ও প্লেট টেকটোনিকস সম্পর্কে ধারণা পাই।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে আইসোটোপের ব্যবহার
- পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার
➤ ইউরেনিয়াম-235 আইসোটোপ পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। - নিউক্লিয়ার ফিশন (nuclear fission) এর মাধ্যমে তাপশক্তি উৎপন্ন
➤ ইউরেনিয়াম-235 এর নিউক্লিয়াস ধীর নিউট্রনের আঘাতে ভেঙে যায় এবং প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে। - তাপশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর
➤ উৎপন্ন তাপশক্তি দিয়ে পানি গরম করে বাষ্প তৈরি করা হয়, যা টারবাইন চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। - বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
➤ পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে অবস্থিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে।
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের ক্ষতিকর প্রভাব
জিনগত পরিবর্তন ঘটায়
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে নির্গত আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি মানবদেহের কোষে থাকা DNA বা জিনে আঘাত করে। এতে জিনের গঠন বদলে যেতে পারে, যাকে বলে মিউটেশন। এই পরিবর্তন ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও যেতে পারে এবং মারাত্মক রোগ দেখা দিতে পারে।
ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে
তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শরীরের কোষকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজন করতে বাধ্য করে, ফলে ক্যান্সার তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে ত্বক, ফুসফুস, অস্থি ও রক্ত ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।
মানুষের দেহকোষ ধ্বংস করে
বিকিরণ শরীরের স্বাভাবিক কোষগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে, যার ফলে রক্তশূন্যতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। এতে মানুষ ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
পরিবেশ দূষণ ঘটায়
তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাতাস, পানি এবং মাটির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশকে দীর্ঘমেয়াদে দূষিত করে। এই দূষণ শস্য, জলজ প্রাণী, গবাদি পশু এমনকি মানুষ পর্যন্ত প্রভাবিত করে।
বিপর্যয় ঘটানো দুর্ঘটনার প্রভাব
- হিরোশিমা ও নাগাসাকি (1945): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফেলা পারমাণবিক বোমায় তৎক্ষণাৎ লাখো মানুষ মারা যায়, এবং পরবর্তী বছরগুলোতে তেজস্ক্রিয়তার ফলে জন্মগত ত্রুটি, ক্যান্সার ও মৃত্যু ঘটে।
- চেরনোবিল দুর্ঘটনা (1986): রাশিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণে তীব্র তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়, বহু এলাকা বাসযোগ্যতা হারায়।
আইসোবার (Isobars)
- ভিন্ন মৌলের পরমাণু
- ভর সংখ্যা একই, কিন্তু প্রোটন সংখ্যা ও নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন
উদাহরণ:
• ¹⁸₄₀Ar, ¹⁹₄₀K, ²⁰₄₀Ca - বৈশিষ্ট্য:
• রাসায়নিক ও ভৌত ধর্ম ভিন্ন
• পর্যায় সারণিতে ভিন্ন স্থানে থাকে
আইসোটোন (Isotones)

- ভিন্ন মৌলের পরমাণু
- নিউট্রন সংখ্যা একই, কিন্তু প্রোটন ও ভর সংখ্যা ভিন্ন
- উদাহরণ:
• ³₁H ও ⁴₂He (উভয়ের নিউট্রন সংখ্যা = ২)
• ¹⁴₆C ও ¹²₈O (উভয়ের নিউট্রন সংখ্যা = ৮) - বৈশিষ্ট্য:
• রাসায়নিক ধর্ম পৃথক
• পর্যায় সারণিতে ভিন্ন স্থানে থাকে